শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার প্রশ্নের ব্যাখ্যা না দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন বলেই উন্নয়ন হচ্ছে। আর বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা থাকায় বাংলাদেশ-লাগোয়া ভারতেও উন্নয়ন হচ্ছে।
মন্ত্রী এও বলেছেন, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা থাকলে ভারতেরও মঙ্গল হবে। তিনি এ বিষয়টিই সে দেশকে বলেছেন।
গণমাধ্যম অনেক সময় অস্থিরতা বাড়ানোর জন্য বানোয়াট খবর দেয় বলেও দাবি করেছেন মন্ত্রী। আর উদাহরণ টেনেছেন মুক্তিযুদ্ধের পরের নানা ঘটনাপ্রবাহ।
চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে গিয়ে তুমুল আলোচনা করা বক্তব্য দেয়ার পরদিন শুক্রবার মন্ত্রী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান।
আগের দিন চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর আয়োজনে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনার সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’
এরপর একজন গণমাধ্যমকর্মী তাকে বলেন, ‘ভারতের কাছে আপনি আহ্বান জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে তারা যেন আবার ক্ষমতায় রাখে। এ বিষয়টি জনগণের কাছে ক্লিয়ার না, ক্লিয়ার করবেন?’
বিষয়টা হচ্ছে- এ কথা বলে শুরু করে মন্ত্রী কথা বলেন মিনিট পাঁচেকের বেশি। তিনি কথা বলেন তার ভারত সফরে গিয়ে দেশটির আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথন নিয়ে।
তিনি বলেন, “আসামের মুখ্যমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ “আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কেন?’
“উনি বললেন, শেখ হাসিনার সেই জিরো টরারেন্স টু টেররিজম। এই ঘোষণার পর… আর দ্বিতীয়ত উনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ক্যান নট বি অ্যা হাব অফ টেরোরিস্ট। এর পরে আসাম, মেঘালয়… সবগুলো জায়গায় আর সন্ত্রাসীর তৎপরতা নেই। সন্ত্রাসীর তৎপরতা না থাকায় তাদের এলাকায় উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে।
“উনি বললেন সন্ত্রাসী না থাকায় আমাদের এলাকায় অনেক উন্নতি হচ্ছে । অনেক হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। এটা হয়েছে কেবল শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স টু টেররিজম ঘোষণার জন্য’।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘আমি ভারত সরকারকে বললাম, আপনার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে শেখ হাসিনা থাকায় স্থিতিশীলতা এসেছে। এই স্থিতিশীলতা আসায় আমাদের দেশেরও মঙ্গল হচ্ছে, আপনার দেশেরও মঙ্গল হচ্ছে। আপনার দেশেও ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হচ্ছে।
‘সুতরাং স্থিতিশীলতা সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট। রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা খুব দরকার। তাতে আপনার দেশেরও মঙ্গল হবে, আমাদের দেশেরও মঙ্গল হবে।’
মোমেন বলেন, ‘আমরা চাই, এই অত্র এলাকায় স্থিতিশীলতা। কোনো ধরনের উশৃঙ্খলতা আমরা চাই না। তা যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে এই সোনালি অধ্যায় যথার্থ হবে।
‘তারপর আমি বলেছি, কিছু কিছু লোক, সময় সময় অনেকগুলো উসকানিমূলক কথা বলে থাকে। আপনাদের দেশেও কিছু দুষ্টু লোক আছে। আমাদের দেশেও দুষ্টু লোক আছে। তারা তিলকে তাল করে। আপনার সরকারের একটা দায়িত্ব হবে এবং আমার সরকারেরও দায়িত্ব হবে তিলকে তাল করার সুযোগ সৃষ্টি করতে না দেয়ার। আমরা যদি এটা করি তাহলে আমাদের সাম্প্রদায়িক সস্প্রীতি থাকবে। আমাদের মধ্যে কোনো অস্থিতিশীলতা, কোনো ধরনের আনসার্টেনেটি থাকবে না।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি, আমরা বদ্ধপরিকর, শেখ হাসিনার এই স্থিতিশীলতা থাকুক। এই ব্যাপারে আপনারা সহযোগিতা করলে আমরা খুব খুশি হব।
‘আর আমি বলেছি যে শেখ হাসিনা যদি বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকেন, তাহলে স্থিতিশীলতা থাকে। অস্থিতিশীলতা থাকলেই কেবল আমাদের উন্নতির মশাল নিবে যাবে।
গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অভিযোগ
দীর্ঘ বক্তব্যে মন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে থাকার বিষয়ে তার দেয়া আগের সমালোচিত বক্তব্যেরও ব্যাখ্যা দেন।
একপর্যায়ে বলেন, ‘এটা স্বাধীন দেশ, আমাদের এখানে বাকস্বাধীনতা আছে, ফ্রিডম অফ স্পিচ আছে, যা যা বলে বলতে পারে। এর পরও কোনো কোনো লোক বলে আমরা নাকি মিডিয়াকে কন্ট্রোল করি, দেখেন আমরা কী কন্ট্রোল করি?
‘আমি যতদিন পাবলিক লাইফে আছি, অবশ্যই মিডিয়া এ নিয়ে গল্প বানাবে। তবে বেশি বেশি ডাহা মিথ্যা বললে খারাপ লাগে আরকি। গল্প বানাক কিছু কিছু।’
পরে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি আরেকটি জিনিস কালকে বলেছি। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিধন করার, তার সারা ফ্যামিলিকে নৃশংসভাবে হত্যা করার আগে ওই সময় একটা প্রচারণা শুরু হয়েছিল, বলা হলো তখন, যিনি রেড ক্রসের চিফ ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা নাকি সব কম্বল চুরি করে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জোক করে বলেছেন, আমার কম্বল কোথায়।
‘তখন বলা হলো যে বঙ্গবন্ধু পরিবারের লোক নাকি ব্যাংক লুট করতে গেছে। তখন একটা মহিলার ছবি দেখাল, বাসন্তী, তাকে একটা জাল পরিয়ে দিয়ে বলল, এই হলো বাংলাদশের অবস্থা।
‘এই ধরনের বিভিন্ন রকম মিথ্যা প্রচার হয়। এখনও দেশে-বিদেশে এই মিথ্যা প্রচারণা লেগেই আছে। একটা খুব অর্গানাইজড ওয়েতে এই কাজগুলো হচ্ছে। আমি বলেছি যে, আপনাদের এ থেকে সাবধান থাকতে হবে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আপনাদের মিডিয়া-টিডিয়া অনেক সময় অস্থিরতা বানানোর জন্য অনেক বানোয়াট খবর-টবর দেন, এটা খুব দুঃখজনক।’
মন্ত্রী বলেন, ‘এ দেশটা আমাদের, এ দেশটার মঙ্গল যদি হয়, তাহলে আপনার আমার সবার… যারা সরকারের সবচেয়ে বড় ক্রিটিক, তাদেরও মনে রাখা উচিত, এ দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তারাও কিন্তু ভালো থাকবেন না।’
মন্ত্রী জানেন ডিজেলের দাম বেড়েছে লিটারে ২৮ টাকা
পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে অন্য এক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুইবার বলেন, লিটারে তেলের দাম ২৮ টাকা বাড়ায় দাম এতটা বাড়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে কারসাজি হচ্ছে। সরকার সে ক্ষেত্রে চেষ্টা করছে।
তবে গত ৫ আগস্ট থেকে লিটারে ডিজেলের দর বেড়েছে আসলে ৩৪ টাকা করে।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি, আমরা খুব কষ্টে আছি, জনগণ খুব কষ্টে আছে। হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেল। ডিমের দাম ৯০ টাকা ছিল, ১৫০ টাকা হয়ে গেলে। আমি অঙ্ক মেলাতে পারিনি।
‘আমাদের দেশে ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৮ টাকা প্রতি লিটারে। একটা ডিম আনতে এক লিটার লাগে না। দাম বাড়া উচিত ছিল এক টাকা বেশি হলে বা কয়েক পয়সা। কিন্তু এ কি কাণ্ড। সবকিছুর দাম হুহু করে বেড়ে গেল। আমরা খুব উদ্বিগ্ন।
‘দ্রব্যমূল্যের জন্য আমরা শঙ্কিত। আমরা চাই এটা কমাতে। এত বাড়বে কেন। চালের দাম ১৫ টাকা বাড়বে কেন, ১০ টাকা বাড়বে কেন?
‘এক লিটার (ডিজেল) যদি ২৮ টাকা বাড়ে, (পণ্যমূল্য) এক টাকা-দুই টাকা যদি বাড়ে, সেটা গ্রহণযোগ্য। এখানে কারসাজি আছে, এখানে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কিছু লোক পিছু লেগেছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। আমি বলেছিলাম যে আমেরিকা যেখানে বছরে এক পারসেন্ট বা দুই পারসেন্টের বেশি ইনফ্লেশন হয় না, সেখানে ৯ পারসেন্ট। ইংল্যান্ডেও দুই পারসেন্টের বেশি হয় না, সেখানে গতকালকে ১০ পারসেন্ট। আর টার্কির মতো একটা বড় অর্থনীতি, সেখানে ৬০-এর ঊর্ধ্বে, পাকিস্তানে ৩৭ পারসেন্ট আর শ্রীলঙ্কায় নাকি ১৫০ প্লাস। আর সেই দিন থেকে আমাদের ৭ পারসেন্ট। সুতরাং আমরা এখানে অনেক ভালো আছি, সেইটাই বলেছি।’
ষাটের দশকের শেষে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সারা বিশ্বে একই পরিস্থিতি হয়েছিল জানিয়ে বর্তমান সময়ের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়ার কথাও বলেন মোমেন।
বলেন, ‘যখন আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়, তেলের দাম বাড়ে আর পৃথিবীতে খাদ্য ঘাটতি হয়। এখনও তেলের দাম বেড়েছে, যুদ্ধ একটা লেগেছে। খাদ্যদ্রব্যেরও দাম বেড়েছে। ভেরি স্ট্রেনজ সিমিলারিটি।