বিভাগের মেসেঞ্জার গ্রুপে দেয়া একটি মেসেজকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের মাধ্যমে থানায় হস্তান্তর করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ বিল্লাল হোসেন।
তবে এ রকম কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় সেই ছাত্রকে বিভাগের শিক্ষকের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
থানায় দেয়া শিক্ষার্থীর নাম মেফতাহুল মারুফ। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন এবং মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক ছাত্র।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মারুফকে শাহবাগ থানায় দেয়া হয়। শুক্রবার দুপুরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক আইনুল ইসলামের জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
যে মেসেজকে রাষ্ট্রবিরোধী ভেবে এই কাজ করেছেন, সেই মেসেজটির স্ক্রিনশট নিউজবাংলার হাতে এসেছে।
সেখান থেকে দেখা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জার গ্রুপ চৌদ্দশিখায় গত বুধবার দুপুরে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
একপর্যায়ে এক শিক্ষার্থী লিখেন, ‘আজকে কীসের মিটিং? এত মিছিল কেন?’
আরেক শিক্ষার্থী লেখেন, ‘২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে সংগঠিত দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ ও বিক্ষোভ।’
তখন মারুফ লেখেন, ‘সিরিজ বোমা হামলা চালাইছে জামায়াতুল মুজাহিদিন নামে একটা জঙ্গি সংগঠন বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত। এই ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি দায়ী তারা হয়, তাহলে ২০০৮ থেকে বর্তমানে গুলশানসহ সকল জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ।’
বৃহস্পতিবার এই মেসেজের স্ক্রিনশট মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসান শান্তের কাছে এলে হাসিবুল সেই মারুফকে প্রথমে হল সংসদের রুমে নিয়ে যান। সেখান থেকে আধা ঘণ্টা পর প্রাধ্যক্ষের রুমে নিয়ে যান।
পরে প্রাধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমকে ডেকে সেই শিক্ষার্থীকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেন।
প্রাধ্যক্ষ বিল্লাল হোসেন সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ছেলেটির (মারুফ) একটি মেসেজ পেয়েছি, যেটা সে তার বিভাগের মেসেঞ্জার গ্রুপে লিখেছে। আর তার ফেসবুক থেকে দেখা গেছে, ছেলেটি ইসলামী ছাত্রশিবির এবং ইসলামী জামায়াতে তালাবা পাকিস্তানের পেজে লাইক দিয়েছে। এগুলো ছাড়া আর কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’
বিল্লাল হোসেনের দাবি, মারুফের সেই মেসেজটি রাষ্ট্রবিরোধী।
প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘এই মেসেজ এবং লাইক দেয়ার বিষয়সহ সার্বিক বিষয়ে আমাদের মনে হয়েছে সে রাষ্ট্র এবং সরকারবিরোধী কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত। তাই এটি যাচাই-বাছাই করার জন্য থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।’
রাষ্ট্রবিরোধিতা আর সরকারবিরোধিতা এক জিনিস কি না আর নিশ্চিত না হয়ে কেন থানায় দেয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নে আর কোনো কথা বলবেন না বলে জানান প্রাধ্যক্ষ।
মারুফ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত শাহবাগ থানার কাস্টডিতে ছিলেন।
তার এক বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সমসাময়িক রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে মেসেঞ্জার গ্রুপে অনেক আলোচনা হয়। এগুলোর জন্য যদি কাউকে থানায় দেয়া হয় তাহলে এটি অপ্রত্যাশিত বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত দেবে, এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘হল প্রশাসন চাইলে বিষয়টা সমাধান করতে পারত। থানাও কোনো প্রমাণ পায়নি। সুতরাং একটা মন্তব্যের জন্য তাকে থানায় দেয়া এবং অর্ধদিন তাকে থানার কাস্টডিতে রাখা- এটা হয়রানি।
‘মূলত এটির মাধ্যমে এই হল প্রাধ্যক্ষ হল ছাত্রলীগের আস্থাভাজন হতে চেয়েছেন। আর এটির মাধ্যমে এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে।’
সকাল থেকেই মারুফের বিভাগ এবং হলের বন্ধুরা থানায় জড়ো হতে থাকেন। পরে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনীম আরেফা সিদ্দিকী বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলামকে থানায় পাঠান।
আইনুল ইসলাম শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মওদূত হাওলাদারের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। পরে মওদূত সংবাদকর্মীদের মারুফের লেখাটি পড়ে শুনিয়ে বলেন, ‘এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ছাত্রশিবির এবং পাকিস্তানের আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের পেজে লাইক থাকায় হল প্রাধ্যক্ষ মহোদয় তাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
‘আমরা যাচাই করে দেখেছি, এটি তার (মারুফ) ব্যক্তিগত মতামত। যে কেউ যেকোনো প্ল্যাটফর্মে সরকারের সমালোচনা করতেই পারে। আর তার লাইক দেয়া পেজগুলোতে তার কোনো রিঅ্যাক্ট বা কমেন্ট পাইনি।
‘আর লাইক দেয়ার বিষয়ে মারুফ আমাদের বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ দেখার জন্য এটি তিনি করেছেন।’
মওদূত বলেন, ‘এসব পেজে তার কোনো পোস্ট, মন্তব্য বা রিঅ্যাকশন না থাকার কারণে আমরা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এই বক্তব্যকে পজিটিভভাবে নিয়েছি। তাই আমরা তাকে মুচলেখা দিয়ে বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টার জিম্মায় ছেড়ে দিচ্ছি।’