বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশকে অর্ধেকেরও কম দামে পরিশোধিত ডিজেল বিক্রির যে প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া, সেটি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব-নিকাশ না করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে না বাংলাদেশ।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রোসনেফ্ট অয়েল রাশিয়া যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে ভ্যাট ও ট্যাক্স ছাড়া প্রতি লিটার পরিশোধিত ডিজেলের দর দাঁড়াবে ৩৫ টাকার সামান্য বেশি। এর সঙ্গে সব কর ও অন্যান্য খরচ যোগ হলেও তা ৫০ টাকার কিছু বেশি হয়।
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটে চাপে পড়া বাংলাদেশের জন্য এই প্রস্তাব নিঃসন্দেহে লুফে নেয়ার মতো। কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তি যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটিও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরও ভাবতে বাধ্য করছে।
বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান অংশই যায় পশ্চিমে। কম দামে রুশ তেল কিনতে গিয়ে সেই রপ্তানিতে প্রভাব পড়ে কি না, সেটিই প্রধান দুশ্চিন্তা।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের কাছে পরিশোধিত তেল বিক্রির প্রস্তাব পাঠায় রাশিয়ার তেল উৎপাদন ও বিপণন কোম্পানিটি।
প্রস্তাবটি যাচাই করতে একটি কমিটিও গঠন করেছে সরকার। অচিরেই ঢাকায় আসছে রোসনেফ্ট প্রতিনিধি দল। ডিজেলের পাশাপাশি বাংলাদেশে অপরিশোধিত তেল পাঠানোর সম্ভাব্যতাও যাচাই করতে চাইছে আরেকটি একটি রুশ বিশেষজ্ঞ দল। তারা চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা যাচাই এবং রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল পরিশোধনে করণীয় ঠিক করবেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একাধিক প্রস্তাব পেয়েছি। এ জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা প্রস্তাবগুলো যাচাই করছে।’
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিভিন্ন অফার পাচ্ছি এবং দামও তুলনামূলক কম। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ছাড়া আরও কিছু দেশের কাছ থেকে প্রস্তাব পাচ্ছি। এমনকি প্রাইভেট সেক্টর থেকেও প্রস্তাব আসছে। এর আগে আমরা রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আমাদের পরিশোধনের সক্ষমতা না থাকায়।’
পেট্রল পাম্পে জ্বালানি নিচ্ছেন যানবাহন চালকরা। ছবি: নিউজবাংলা
সরকার স্পষ্টত এই প্রস্তাব নিয়ে ইতিবাচক। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে তেল কেনার আগ্রহের কথা বলেছেন। রাশিয়ার প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলেছেন তিনি।
রুশ কোম্পানির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে গত সপ্তাহেই ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের সঙ্গে বৈঠক করে বিপিসি। বৈঠকে প্রস্তাবটি বিশ্লেষণের জন্য বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (কমার্শিয়াল অ্যান্ড অপারেশনস) মোস্তফা কুদরত এলাহীর নেতৃত্বে একটি দল গঠন করা হয়।
বিচার-বিশ্লেষণ কী নিয়ে
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, ‘বিষয়টি ইউরোপ ও আমেরিকা কোন দৃষ্টিতে নেবে এটা একটা বড় বিবেচ্য বিষয়। তার কারণ আমাদের এক্সপোর্টের বড় মার্কেট ইউরোপ ও আমেরিকা। তার ওপর এটার প্রভাব পড়বে কি না, তা ভেবেচিন্তে এগোতে হবে।’
জ্বালানি পরামর্শক খন্দকার সালেক সুফী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোন মুদ্রায় কিনব? এর প্রতিক্রিয়া কী হবে? বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ দিন যত যাচ্ছে, জ্বালানি তেলের কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় টান পড়ছে। সরাসরি যদি নাও কিনতে চাই, তাহলে যারা কিনছে তাদের কাছ থেকেও নেয়া যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই রাশিয়া থেকে তেল নিচ্ছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ম তামিম চাইছেন বাংলাদেশ রুশ তেল কিনুক।
তিনি বলেন, ‘খরচ কম পড়লে আমাদের অবশ্যই উচিত হবে পরিশোধিত তেল কেনা। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে যদি দাম কম হয় এবং পরিবহন খরচ মিলিয়ে মোট মূল্য যদি কম আসে, আমাদের অবশ্যই এই তেল কেনা উচিত।’
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত এত সহজে নেয়া যায় না। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত বুঝেশুনেই নেবে বাংলাদেশ। কেননা বড় দেশগুলো রাশিয়া থেকে তেল কিনতে সাহসী হলেও বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তা সহজ নয়।’
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরও সাবধানতার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের বিরোধের মধ্যে সে দেশ থেকে তেল কেনার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সেনসিটিভিটি মাথায় রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘রাশিয়ায় মুদ্রা রুবল খুব একটা পাওয়া যাবে না। চীনের মুদ্রা ইউয়ান কিনে তা দিয়ে তেলের দাম পরিশোধ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে ডিপ্লোম্যাটিক সেনসিটিভিটিকে (কূটনৈতিক সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা)। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে আমাদের রপ্তানির ৮০ শতাংশ বাজার। তাদের অসন্তুষ্ট করে কোনো কাজ করা যাবে না।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, রুশ প্রস্তাব বিশ্লেষণে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি আলোচনা করছে।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আমরা কাজ শুরু করেছি। এখনই বলার মতো কোনো আপডেট নেই।’
ঢাকায় আসছে রুশ দল
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, রুশ কোম্পানির এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য তাদেরকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারা এলে কোন প্রক্রিয়ায় তেল আসবে, অর্থ পরিশোধ কীভাবে হবে, কোন ব্যাংক, কোন মুদ্রায় লেনদেন হবে, শর্ত কী হবে, ক্লিয়ারেন্স ফ্যাসিলিটিজ কী হবে, রুট, বন্দর, প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়েই মূলত আলোচনা হবে। দাম নির্ধারণের বিষয়ও রয়েছে।
দাম কত পড়বে?
বিপিসির তথ্য বলছে, রুশ প্রতিষ্ঠান রোসনেফ্ট প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেল ৫৯ ডলারে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। এই দরে তারা চট্টগ্রামে তেল পৌঁছে দেবে।
এক ব্যারেল সমান ১৫৯ লিটার। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসাবে সে ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পরিশোধিত ডিজেলের দর পড়ে ৩৫ টাকা ২৫ পয়সার কিছু বেশি।
প্রস্তাবিত দরের সঙ্গে ব্যারেলপ্রতি ৩ ডলার প্রিমিয়াম (জাহাজ ভাড়া, বিমা, লোড-আনলোড, ঝুঁকি ও ব্যাংক সুদ) এবং ৩৮ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স যুক্ত হবে। সে হিসাবে ভ্যাট ও ট্যাক্স বাদে লিটারপ্রতি ডিজেলের দর দাঁড়াবে ৫০ টাকার কিছু বেশি।
সরকার জ্বালানি তেল আমদানিতে ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি প্রস্তাব তৈরি করতে বলেছে। ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানো হলে প্রতি লিটার রুশ ডিজেলের দর ৫০ টাকার নিচে নেমে আসবে।
কত দরে তেল আনে বাংলাদেশ
বর্তমানে বিপিসি আটটি দেশ থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। দেশগুলো হলো কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারত।
বর্তমানে প্রতি ব্যারেল ডিজেল আমদানি করতে ১২৫ ডলারের মতো খরচ পড়ছে। আর অপরিশোধিত ক্রুড অয়েল আনতে খরচ পড়ছে ৯০ ডলার।
এই হিসাবে প্রতি লিটার ডিজেলের আমদানি ব্যয় পড়ছে ১২২ টাকা ১৩ পয়সা, যা বিক্রয়মূল্য ১১৪ টাকার চেয়ে ৮ টাকা বেশি।
বাংলাদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬১ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর তিন-চতুর্থাংশই পরিশোধিত তেল। দেশে ব্যবহৃত তেলের ৭০ শতাংশের বেশি ডিজেল। দেশে ৫৫ লাখ টনের বেশি ডিজেল প্রয়োজন পড়ে। এর ৪৫ হাজার টনই আমদানি করা।
ভারত ও চীন নিচ্ছে রুশ তেল
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অবরোধে পড়া রাশিয়া তার তেল বিক্রির ক্ষেত্রে দাম কমিয়ে পাল্টা চাল দিয়েছে।
এরপর বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুই দেশ চীন ও ভারত এই তেলের বড় আমদানিকারক হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ শুরুর পর দেশ দুটি ৩৫ শতাংশ ছাড়ে তেল কিনছে।
বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারও রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে।