বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লঞ্চ মালিকরা খুশি এক হাজারে, সরকার ঠিক করল ১৮৩৬

  •    
  • ১৮ আগস্ট, ২০২২ ০৮:৩০

এক লঞ্চ মালিক জানান, সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, সেটা যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া যাবে না। লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা সিন্ডিকেট করে ভাড়া বাড়িয়েছে।

ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে এতদিন দুশ্চিন্তায় ছিলেন যাত্রীরা। এবার এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় লঞ্চ মালিক ও শ্রমিকরা।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সরকার লঞ্চের ভাড়া যেভাবে বাড়িয়েছে, সেই ভাড়ায় যাত্রী পাওয়া যাবে কি না, এ নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন বরিশালের লঞ্চসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

যে কারণে সরকার যে হারে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, নেয়া হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। আর সেই কম নিয়েও ভালোই মুনাফা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন লঞ্চসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন যারা, তারা প্রশ্ন তুলছেন, যদি নির্ধারিত হারের চেয়ে কম নিয়ে লঞ্চ লাভে থাকতে পারে, তাহলে এত বেশি হারে ভাড়া নির্ধারণ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আসলে কার স্বার্থ দেখেছে?

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এমনিতে যাত্রীসংকটে ভোগা লঞ্চগুলোতে ভাড়া কমিয়ে যাত্রী ফেরানোর চেষ্টা ছিল। এর মধ্যে ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপথে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে ৩০ শতাংশ। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ৩ টাকা।

এই হার সড়কপথে ভাড়া বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। সড়কপথে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৬ শতাংশ আর দূরপাল্লায় ২২ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। আর নগরে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া আড়াই টাকা আর দূরপাল্লায় ২ টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছে।

সড়কের চেয়ে নৌপথে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া কেন বেশি হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। তবে এই হারে যে ভাড়া আসে, তা দেখে বরিশালের যাত্রীরা রীতিমতো আঁতকে উঠেছেন। ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে নৌপথে কেন যাবেন, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

‘সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিলে যাত্রী কমবে, লোকসান হবে’

ঢাকা-বরিশাল রুটে চলা এমভি মানামীর সুপারভাইজার শাহাদাৎ ইসলাম শুভ বলেন, ‘নভেম্বরে তেলের দাম বাড়ানোর পর ডেকের ভাড়া ৩৫২ টাকা করা হয়। সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া সে সময় হয় ১ হাজার ৪০০ টাকা আর ডাবল কেবিনের ২ হাজার ৬০০ টাকা। তখনই যাত্রী কমে গিয়েছিল। এরপর পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রীর ভাটা নামে। যে কারণে ডেকে ২০০ টাকায়, সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ও ডাবল কেবিন ২ হাজার টাকা নেয়া হতো। এতে ধীরে ধীরে যাত্রী বাড়ছিল।

‘তবে ডেকে ৪৫৮ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার ৮৩৬ ও ডাবল কেবিন ৩ হাজার ৬৫০ টাকা করেছে সরকার। এই ভাড়ায় যাত্রী নেয়া শুরু করলে আবারও যাত্রী কমতে থাকবে।’

তাহলে আপনারা কত টাকা ভাড়া নিচ্ছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ডেকে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার ৫৮ টাকা কমিয়ে ৪০০ টাকা করে নিচ্ছি। আর কেবিনের ভাড়া সেই আগেরটাই রয়েছে, সিঙ্গেল কেবিনে ১ হাজার আর ডাবল কেবিনে ২ হাজার টাকাই নেয়া হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে যদি সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিতে থাকি তাহলে যাত্রী কমবে এবং লোকসান হবে। তার থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাড়া রাখার চেষ্টা করছি আমরা।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে আরও এক লঞ্চ মালিক বলেন, ‘সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, সেটা যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া যাবে না। ভাড়া বাড়িয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা সিন্ডিকেট করে। ঈদে লঞ্চগুলো সরকার নির্ধারিত ভাড়াই রাখবে।’

‘এত ভাড়া কি লঞ্চ মালিকদের ভালোবাইসা?’

লঞ্চ ভাড়া বাড়ার কারণে অনেক যাত্রীকেই বরিশাল নদীবন্দর থেকে ঘুরে যেতে দেখা গেছে। তারা বাসে করে পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় আসবেন বলে জানিয়েছেন।

সাইফুল শাহ নামের এক যাত্রী বলেন, ‘ডেকে এত ভাড়া বেড়েছে তা ভাবিনি। অতি জরুরি কোনো কাজও নেই। তাই লঞ্চঘাট ত্যাগ করছি। কাল ৫০ টাকা কমে বিএমএফ পরিবহনে ঢাকা যাব।’

বরিশাল নদীবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে মঙ্গলবার রাত সোয়া ৯টার দিকে ছেড়ে যায় পারাবত ১১, সুরভী ৯, সুন্দরবন ১০, অ্যাডভেঞ্চার ১ ও মানামী লঞ্চ। সব লঞ্চের ডেক ভরা দেখা গেলেও কেবিন প্রায় সব লঞ্চেই ফাঁকা ছিল।

যাত্রীদের একটি বড় অংশ বলেছে, নতুন ভাড়ার বিষয়ে তারা জানতেন না। জানলে লঞ্চে উঠতেন না। তাদের মতে, এত বেশি ভাড়ায় যাতায়াত করা সম্ভব নয়।

এক যাত্রী বলেন, ‘লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তো জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ৩০০ বা ৩৫০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী নিয়েছে। তারা তো লোকসানে ছিল না। তাহলে এত বেশি ভাড়া কেন সরকার ঠিক করে দিল?’

মানামী লঞ্চে ডেকের যাত্রী শাওন হাওলাদার বলেন, ‘গত সপ্তাহে ঢাকায় মাল আনতে গেছিলাম ২৫০ টাকা ভাড়া দিয়া পারাবাত লঞ্চে। ওই সময় অনেক লঞ্চে ৩০০ টাকা নিতেও দেখছি। এই ভাড়া কিন্তু নেয়া হইত তেলের দাম বাড়াইন্নার পর। এই ভাড়ায় যদি লঞ্চ মালিকগো ক্ষতি না অয়, তাইলে নতুন কইরা ভাড়া বাড়াইয়া কেন সাধারণ মানুষরে ভোগান্তিতে ফেলা হইতেছে? লঞ্চ মালিকদের ভালোবাইসা?’

‘সরকার কাদের পক্ষে বুঝতেছি না’

আবুল হোসেন নামের আরেক যাত্রী বলেন, ‘সরকার কাদের পক্ষে বুঝতেছি না। যেখানে অলরেডি লঞ্চ মালিকরা লাভবান, সেখানে তাদের আরও লাভবান করা হচ্ছে জনগণের পকেট কেটে। যদি লঞ্চ চালাতে লোকসান হতো, তাহলে কি মনে হয় লঞ্চ মালিকরা লঞ্চ চালাত?

‘এক টাকা লস হলেই লঞ্চ বন্ধ করে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেখানে তারা তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর আগে নির্ধারিত ৩৫০ টাকার কম ভাড়ায়ও যাত্রী পরিবহন করেছে। সেখানে নতুন করে ভাড়া বাড়ানোটা সার্কাস মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সরকার রোলার চাপা দিচ্ছে।’

লঞ্চ মালিক সমিতি অবশ্য সরকারকে ৩০ শতাংশ নয়, শতভাগ ভাড়া বাড়ার সুযোগ দিয়েছিল।

সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। ডেকের ভাড়ার থেকে চার গুণ ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে কেবিনে। আশা করছি আমাদের লোকসান কমবে এবারে। তাছাড়া ভাড়া যে পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছিলাম, সেই পরিমাণও বাড়ায়নি। আর পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা কমলেও ধীরে ধীরে এখন বাড়ছে।’

‘সরকারের ভাড়ায় যাত্রী পাব না’

কেবল বরিশাল থেকে ঢাকার পথে নয়, ঢাকা থেকে বরিশালের পথেও একই চিত্র। সদরঘাট যেন খাঁ খাঁ করছে।

বুধবার রাত ৮টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে নদীপথে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে ঘুরে দেখে মেলেনি যাত্রীর সরব আনাগোনা। চাঁদপুর, ভোলাসহ অন্যান্য নৌরুটে যাত্রী থাকলেও অন্য রুটগুলোতে যাত্রী খুবই কম।

রেডসন ৫, এম ভি কুয়াকাটা ১, ২-এর সুপারভাইজার রফিকুল ইসলাম রাজু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাত্রী অনেক কম। সচরাচর এমন কম থাকে না। ইদানীং তো আরও কম।’

এমভি পারাবাত ১৮ লঞ্চের মালিক ও সমিতির মহাসচিব শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই ভাড়া যাত্রীর কাছে চাইলে টিকিটই নিতে চাইবে না। তাই আমরা কম রাখছি।’

সুন্দরবন লঞ্চের মালিক ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের লঞ্চগুলোতে যাত্রী টানতে সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয় আমরা সরকারের নজরে আনছি। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যানজট মুক্ত করাসহ সদরঘাট এলাকায় নিরাপত্তা ও ঘিঞ্জি দূর করতে আমরা ওপর মহলে বারবার বলে আসছি।’

‘তাহলে ভাড়া বাড়ল কেন?’

যাত্রী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন ব‌রিশাল নৌযাত্রী ঐক্য প‌রিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আব্দুর র‌শিদ নিলু বলেন, ‘য‌দি আগের ভাড়ায় যাত্রী নিতে লঞ্চের সমস্যা না হয়, তাহলে নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর তো কোনো যৌ‌ক্তিকতা দেখ‌ছি না।

‘এটাই প্রমাণ করে নৌপ‌রিবহন মন্ত্রণালয় লঞ্চ মা‌লিকদের কথা মতো ভাড়া বা‌ড়িয়েছে, তারা আসলে কোনো যাচাই-বাছাই করেনি। তাদের উচিত ছিল মাঠপর্যায়ে এসে বিষয়‌টি দেখা।’

স‌ম্মি‌লিত সামা‌জিক আন্দোলন ব‌রিশাল জেলা ক‌মি‌টির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ‘আগের ভাড়াতেই যখন লোকসান হচ্ছে না, তখন নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর কী দরকার? আসলে সরকারের সঙ্গে লঞ্চ মা‌লিকদের আলোচনার সময় যাত্রীর পক্ষ হয়ে কেউ থাকে না। সেই সময়টাতেই সরকারকে ভুলভাল বু‌ঝিয়ে লঞ্চ মা‌লিকরা ভাড়া বা‌ড়িয়ে নেয়।

‘ঢাকা-ব‌রিশাল রুটের প্রতি‌টি লঞ্চে যাত্রী ধারণক্ষমতা ৯০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ পর্যন্ত। তবে তারা যাত্রী বহন করে থাকে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি। পাশাপা‌শি যে পণ্য প‌রিবহন করা হয়, সেটিও তোলা হয় না ভাড়া বাড়ানোর আলোচনায়।’

বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তার উদ্ভট যুক্তি

যে ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো মুনাফা করছে, তার চেয়ে বেশি ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পথের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, ভাড়া না বাড়ালে লঞ্চগুলো চলতে পারত না।

তার দাবি, লঞ্চে সব সময় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম নেয়া হয়। এবারও তাই হচ্ছে।

তাহলে এত ভাড়া নির্ধারণের দরকার কী- আরও কম বাড়লে পারতেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সরকারের গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত। আপনি যেটা মনে করছেন, ৩০ শতাংশ, সেটা হয়ত কথার কথা। ২৫ শতাংশ বা ২২ শতাংশ বাড়ালে যেটা হতো, সেটা আদায় করা হচ্ছে।’

এ বিভাগের আরো খবর