কামাল হোসেন কমলের বাড়ি পটুয়াখালীতে। ১৫ বছর আগে ঢাকায় এসে তিনি রিকশা চালানো শুরু করেন। ভাড়ায় চালানো সেই রিকশাটি একদিন চুরি হয়ে যায়। ধারদেনা করে মালিককে সেই রিকশার দাম পরিশোধ করেন কমল।
জীবন-যুদ্ধ শুরুর দিকের এই ঘটনা পুরোপুরি পাল্টে দেয় এই যুবককে। নিয়ে যায় অন্ধকার জগতে। চুরি হয়ে যাওয়া রিকশার খোঁজ করতে গিয়ে তিনি সন্ধান পান চোর চক্রের। একপর্যায়ে নিজেও জড়িয়ে পড়েন এই চক্রে। নিজেই গড়ে তোলেন রিকশা চোর চক্র।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা চুরির পর সবুজবাগ-মুগদা এলাকায় বিভিন্ন গ্যারেজে সেগুলো রাখতেন কমল। পরে রং পরিবর্তন করে সেগুলো বাজারে বিক্রি করতেন। চক্রটি ৭ বছরে পাঁচ শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা চুরি ও ছিনতাই করেছে। সর্বস্বান্ত করেছে গরিব রিকশাচালক ও মালিকদের।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বুধবার ভোরে কমলসহ এই চোর চক্রের চার সদস্য ধরা পড়েছেন র্যাবের হাতে। অন্য তিনজন হলেন- সাজু, ফজলু ও শাহিন সরদার। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২৩টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ১৮টি রিকশার চার্জার ব্যাটারি, চারটি মোবাইল ফোন, চারটি মাস্টার চাবি ও নগদ ১৬০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
রিকশা চোর চক্রের প্রধানসহ চারজনকে আটকের পর উদ্ধার হওয়া ব্যাটারিচালিত রিকশা। ছবি: নিউজবাংলা
কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ। সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, কমল এই চক্রের হোতা। তিনি ১২ বছর ধরে রিকশা চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। প্রথমে তিনি একাই রিকশা চুরি করতেন। যাত্রী হিসেবে রিকশায় উঠে পথে চালককে নেশাযুক্ত কোমল পানীয় খাইয়ে অজ্ঞান করে তিনি রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেতেন। আবার কখনও রিকশাচালক কোমল পানীয় খেতে রাজি না হলে তার নাকের কাছে চেতনানাশক ভেজানো রুমালের ঘ্রাণ দিয়ে অজ্ঞান করে রিকশা চুরি করতেন।
লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, একা একা রিকশা চুরিতে হাত পাকিয়ে কমল ধীরে ধীরে একটি চক্র গড়ে তোলেন। চক্রটি অভিনব কায়দায় রিকশা চুরি করত। তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াত। সাজু ওই রিকশা চালিয়ে যেতেন। পথে নতুন কোনো রিকশা দেখলে সেটিকে টার্গেট করা হতো।
কমল টার্গেট করা রিকশার চালককে বলতেন- সামনের রাস্তায় একটি বাসা থেকে আমার কিছু মাল তুলব। ওই মালগুলো কাছাকাছি আরেকটি বাসায় পৌঁছে দিলে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দেয়া হবে। এরপর ওই রিকশার চালকের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করতেন। বেশি ভাড়ার রিকশাচালকও প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতেন। পরে সুবিধামতো একটি বাসার সামনে রিকশা থামিয়ে কমল চালককে বলতেন, বাসার ভেতরে ঢুকে মালামাল নিয়ে আসতে হবে। চালক সে অনুযায়ী বাসায় প্রবেশ করা মাত্র চক্রের অপর সদস্য ফজলু রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেতেন। এই পর্যায়ে রিকশা হারিয়ে চালক কান্না শুরু করলে রিকশা খোঁজার নাম করে কমলও সটকে পড়তেন।
চক্রটি এভাবে চুরি করা রিকশাগুলো রাজধানীর সবুজবাগ ও মুগদা এলাকায় শাহীন, আকবর, মনির ও বাবলুর গ্যারেজে নিয়ে লুকিয়ে রাখত। তারপর রিকশার মালিককে ফোন করে ‘মুক্তিপণ’ দাবি করত। তারা সেই টাকা বিকাশের মাধ্যমে আদায় করত। এরপর একটি অজ্ঞাত স্থানে রিকশা রেখে মালিককে ফোন করে রিকশা নিয়ে যেতে বলত।
রিকশা চুরির পর আলাদাভাবে বিক্রির জন্য রাখা চার্জারও উদ্ধার করে র্যাব। ছবি: নিউজবাংলা
কৌশল পরিবর্তন
র্যাব জানায়, সহযোগীসহ কমল একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর চুরির এই কৌশল ফাঁস হয়ে যায়। এরপর জামিনে বেরিয়ে এসে চক্রটি চুরির কৌশল পাল্টে ফেলে। এই পর্যায়ে কমল ও তার সহযোগীরা যাত্রী হিসেবে রিকশায় উঠে নির্জন স্থানে নিয়ে চালককে মারধর করে হাত-পা বেঁধে রাস্তায় ফেলে রেখে রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেতেন। পরে রং পরিবর্তন করে খোলাবাজারে সেটি নতুন হিসেবে বিক্রি করে দিতেন। কখনও রিকশার মোটর পার্টস খুলে আলাদাভাবে বিক্রি করতেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রিকশা চুরি চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী কমল। চক্রটি রিকশা চুরির জন্য মূলত বাসাবো বাসস্ট্যান্ড ও মান্ডা এলাকাকে বেছে নিত। আর চুরির পর রিকশাটি চালিয়ে নিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতেন তার সহযোগী সাজু। আরেক সহযোগী ফজলুর সহায়তায় রং ও সিট কভার পরিবর্তন করে রিকশাগুলো ৫ হাজার থেকে ১২ টাকা দামে বিক্রি করা হতো।
র্যাব জানিয়েছে, কমলের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৭টি চুরির মামলা এবং ফজলুর নামে একটি মাদক মামলা রয়েছে। শাহিন মান্ডা খালপাড় এলাকায় ৩০ বছর ধরে রিকশার একটি গ্যারেজ পরিচালনা করে আসছেন। ৭ বছর আগে এই চোর চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি চোর চক্রকে তার গ্যারেজ ব্যবহার করে চোরাই রিকশা রাখা ও বিক্রিতে সহায়তা করতেন। আর রিকশা বিক্রির টাকা থেকে তিনি ১০ শতাংশ কমিশন পেতেন।