উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পে ফ্লাইওভারের বক্স গার্ডার দুর্ঘটনায় মর্মাহত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘটনায় প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট যার যার গাফিলতি আছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চান।
সোমবার এই দুর্ঘটনার পর পরই প্রকাশ পায়, নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া ভারী বস্তুটি সরানো হচ্ছিল। এই ঘটনায় জনক্ষোভের মধ্যে মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি, একনেকের সভায় প্রসঙ্গটি তোলেন সরকার প্রধান। সভায় ভার্চুয়ালি যোগ দেন তিনি।
সভা পরবর্তী ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘উত্তরার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মর্মাহত। তিনি বলেছেন, এটা কেন হলো? এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কী, সেটিও জানান মান্নান। বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রকল্প পরিচালক থেকে ঠিকাদার- সংশ্লিষ্ট সবাইকেই তদন্তের মধ্যে আনতে হবে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
বক্স গার্ডার দুর্ঘটনায় মর্মাহত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘটনায় প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট যার যার গাফিলতি আছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চান। ফাইল ছবি
বিআরটি প্রকল্পটি চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড বাস্তবায়ন করছে। তাদের কোনো বক্তব্য আপাতত পাওয়ার সুযোগ নেই।
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি গেলেও তারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি। বিআরটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তবে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে বারবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
পরিবহন সচিব বিআরটির চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দায় কি আমার? আমি কি মালিক? আমি কি বিআরটি প্রকল্প পরিচালক? আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন।’
উত্তরায় নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের এই বক্স গার্ডার দুর্ঘটনায় প্রাইভেটকারের পাঁচ আরোহী মারা গেছেন। দুইজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন নারী ও দুটি শিশু রয়েছে। জসীম উদ্দীন মোড়ে প্যারাডাইজ টাওয়ারের সামনের সড়কে সোমবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে।
এরই মধ্যে এই ঘটনার তদন্তে গঠন করা হয়েছে একটি কমিটি। এক দিনের মধ্যেই প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন সচিবের কাছে। এতে দায়ী করা হয়েছে ঠিকাদারি কোম্পানিকে।
সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেছে
সিসিটিভি ক্যামেরায় দুর্ঘটনার যে ভিডিও পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, ব্যস্ত সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রেখেই ক্রেনে করে বক্স গার্ডারটি একটি গাড়িতে তোলা হচ্ছিল। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এই বিষয়টি নিয়ে কর্মীদের মধ্যে কোনো ভাবান্তরই ছিল না।
হঠাৎ করেই গার্ডারটি পিছলে পড়ে যায়। যে গাড়িতে সেটা তোলার কথা ছিল, সেটার পাশ দিয়ে যাওয়া প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে সেটি। সেই গাড়িতে নবদম্পতি ছাড়াও তাদের পাঁচ জন স্বজন ছিলেন। মারা গেছেন সেই স্বজনরা।
নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া কাজ করতে গিয়ে উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ভায়াডাক্টের একাংশ পড়ে ৫ জন নিহতের পর নিরাপত্তায় জোর। ছবি: নিউজবাংলা
‘ঠিকাদার, বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এবং তদারকি সংস্থা সবাই দায়ী’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান এই প্রাণহানির জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অবহেলাকে দায়ী করেছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যখন ভারী উপকরণ বা সরঞ্জাম আপনি বহন করবেন, সেটা ক্রেনের মাধ্যমে হোক আর যেকোনো মাধ্যমে হোক না কেন, ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিসটা হচ্ছে অবশ্যই একটা নিরাপত্তা-বেষ্টনী তৈরি করতে হবে আগে। কারণ, ক্রেন থেকে গার্ডার কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে পড়ে যেতেই পারে, সে কারণেই আপনাকে পূর্ব সতর্কতা নিতে হয়। ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস হচ্ছে আমাকে সেই জায়গাতে আগেই কর্ডন বা নিরাপত্তা-বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। ওই বেষ্টনীর মধ্যে যেন পথচারী বা কোনো যানবাহন ঢুকতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্বও কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।’
যে ক্রেন দিয়ে গার্ডারটি তোলা হচ্ছিল, সেটি যিনি চালাচ্ছিলেন, তার দক্ষতা ছিল কি না, ক্রেনটি যার চালানোর কথা তিনিই তা করছিলেন নাকি অন্য কেউ করছিলেন-এসব প্রশ্নেরও জবাব মিলছে না।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মনে করেন, এই ঘটনায় কেবল কর্মী নয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এবং তদারকি সংস্থা সবার গাফিলতি ছিল। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্পে কিন্তু এই ম্যানেজমেন্টের জন্য একটা বড় ব্যয় ধরা থাকে। আমার মনে হয়, বিআরটি প্রজেক্টে প্রথম থেকেই কনস্ট্রাকশন প্র্যাকটিসের ন্যূনতম যে গ্রামারটা আছে, সেটা তারা ফলো করছে না।
‘কিন্তু তারা ঠিকমতো প্র্যাকটিস করছে কি না, এটার নজরদারি বা তদারকির দায়িত্ব তো বাস্তবায়নকারী সংস্থার। এই ধরনের প্রকল্পের সুপারভিশনের দায়িত্ব আরেক সংস্থার থাকে।
‘তার মানে কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেটার জন্য সুপারভিশন সংস্থা আছে, আমাদের বাস্তবায়নকারী সংস্থা আছে, এটার একটা সমন্বয় দরকার। আমি যেটা মনে করি, এই ধরনের কাজ একটা বড় কাজ।
‘পাশাপাশি এটা অনেক বিজি একটা করিডর। এই করিডরে কাজ করতে গেলে অবশ্যেই যারা বাস্তবায়ন করছে তাদের ২৪ ঘণ্টা ৭ দিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি এবং তদারকি করতে হবে। কোথাও যদি কনস্ট্রাকশন প্র্যাকটিসের ব্যত্যয় হয়, তাকে কিন্তু জবাব দিতে হবে। এই জবাব দিতে হয় না বলেই আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে হয় না। তাদের মধ্যে অবহেলার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।’