বাসভাড়ায় নৈরাজ্য নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর চাপে পড়া বাস মালিক সমিতি ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ ঘোষণার পর সড়কে দেখা যাচ্ছে কৌশলী পদক্ষেপ।
সাভারের ইপিজেড থেকে নারায়ণগঞ্জের লিংক রোড পর্যন্ত চলাচলকারী লাব্বাইক পরিবহনের ওই বাসের চালক দাবি করছে, তারা ওয়েবিল পদ্ধতি থেকে সরে এসে কিলোমিটার দূরত্বে ভাড়া কাটছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়।
কিলোমিটারের হিসাব বাদ দিয়ে তারা আগের মতোই এক চেক থেকে আরেক চেক পর্যন্ত দূরত্বে বাড়তি ভাড়াই আদায় করছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ঘোষণা ছিল ১১ আগস্ট থেকে ওয়েবিলের বদলে কিলোমিটারের দূরত্ব হিসেবে প্রথম চার কিলোমিটার পর্যন্ত ১০ টাকা, এরপর প্রতি কিলোমিটারের জন্য আড়াই টাকা হারে ভাড়া কাটবে।
কিন্তু এই ঘোষণার চতুর্থ দিন লাব্বাইক পরিবহনের কয়েকটি বাসে উঠে দেখা যায় যাত্রীদের থেকে সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে দূরত্ব ভেদে ৫ থেকে ২১ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করা হচ্ছে।
হেমায়েতপুর থেকে কমলাপুর ২১ দশমিক ৮ কিলোমিটারে ভাড়া আসে ৫৪ দশমিক ৫ পয়সা। চার্টের ভাড়া ৫৯ টাকা। যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেছে ৭৫ টাকা। বেশি নিয়েছে ২০ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়েছে ৩ টাকা ৪৪ পয়সা।
কারওয়ান বাজার থেকে সাইনবোর্ড ১৮ কিলোমিটারের ভাড়া নিয়েছে ৫০ টাকা। তবে নতুন চার্টের ভাড়া এই দূরত্বে ৪৫ টাকা। ভাড়া বেশি নিয়েছে ৫ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়েছে ২ টাকা ৭৭ পয়সা।
ফার্মগেট থেকে মৌচাক পর্যন্ত ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটারের চার্টে ভাড়া ১০ টাকা। যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেছে ১৫ টাকা। ভাড়া বেশি নিয়েছে ৫ টাকা।
সাভার থেকে মালিবাগ ২৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরত্বে চার্টে ভাড়ার অংক ৫৯ টাকা থাকলেও দুজনের কাছ থেকে ৮০ করে ১৬০ টাকা নেয়া হয়েছে। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়েছে ৩ টাকা ৪০ পয়সা।
এই বাসের যাত্রী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তো জানতাম না এই দূরত্বে ভাড়া ৫৯ টাকা। ও আমার কাছে ভাড়া চেয়েছে ৮০ টাকা। আমরা দুজন ভাড়া দিয়েছি ১৬০ টাকা। আপনি ভাড়ার চার্ট দেখে বললেন ভাড়া ৫৯ টাকা। এখন আপনি বলেন এদের কী করতে মনে চায়?’
বাড়তি ভাড়া নেয়ার কারণে মালিবাগ রেলগেট এলাকায় যাত্রীরা এই বাসের ভাড়া কাটার দায়িত্বে থাকা মো. সাইফুলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক যাত্রী তার বাড়তি ভাড়া সাইফুলের কাছ থেকে আদায় করে নেন।
পরে সাইফুল বাসে থাকা একটি মাত্র ভাড়ার চার্ট ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় যাত্রীরা ভাড়ার চার্ট ছিঁড়ে ফেলার কারণ জানতে চাইলে সাইফুল বলেন, ‘এটা পুরাতন চার্ট।’
তবে সাইফুল ভাড়ার চার্ট ছিঁড়ে ফেলার আগেই ভাড়ার চার্টের তোলা ছবিতে দেখা যায়, এটি বিআরটিএ থেকে দেয়া ভাড়ার নতুন তালিকা।
পরে সাইফুলকে চার্ট ছিঁড়ে ফেলার কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়েও কিছু চাইলেও কোনো উত্তর দেননি।
লাব্বাইক পরিবহনের আরেকটি বাসে কল্যাণপুর থেকে বাংলামোট ৫ দশমিক ৭ কিলোমিটারে চার্টের ভাড়া ১৪ টাকা থাকলেও ভাড়া আদায় করেছে ২০। বেশি নিয়েছে ৬ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়েছে ৩ টাকা ৫০ পয়সা।
কলেজ গেট থেকে মালিবাগ ৬ দশমিক ৭ কিলোমিটারের চার্টের ভাড়া ১৭ টাকা। তবে এক যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে ৩০। ভাড়া বেশি নিয়েছে ১৩ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়েছে ৪ টাকা ৪৭ পয়সা।
গাবতলী থেকে খিলগাঁও ১২.৬ কিলোমিটারে ভাড়া আসে ৩১ দশমিক ৫ টাকা। ভাড়া আদায় করেছে ৩৫ টাকা। বেশি নিয়েছে ৩ টাকা ৫ পয়সা।
এই বাসের যাত্রী মুরাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের চার জনের কাছ থেকে গাবতলী থেকে খিলগাঁওয়ের ভাড়া নিয়েছে ১৪০ টাকা। কিন্তু চার জনের ভাড়া আসে ১২৬ টাকা। একেক জনের থেকে সাড়ে তিন টাকা বেশি নিলেও সব মিলিয়ে ১৪ টাকা বেশি নিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে ১০ টাকার জায়গায় ১১ টাকা ভাড়া আসলেই তারা রাউন্ড ফিগার করে ১৫ টাকা ভাড়া নেয়।’
বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে জানতে ভাড়া কাটার দায়িত্বে থাকা মো. আদনান বলেন, ‘আমার কোনো কথা নাই ভাই। চেকারের সঙ্গে কথা বলেন।’
ইস্কাটন এলাকায় বাস থেকে নেমে বাসের যাত্রী সংখ্যা গুনে ওয়েবিলে সই করা মো. সাগরকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাড়তি ভাড়া নেয়া হয় না।’
যাত্রীরা সবাই বলছে তাদের থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে এবং আগের মতোই আপনারা ওয়েবিলে ভাড়া নিয়েছেন। উত্তরে সাগর বলেন, ‘ওয়েবিল চালু নাই।’
আপনি নিজেই তো যাত্রী গুনে সংখ্যা লিখলেন ওয়েবিলে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমনে হিসাব রাখছে।’
পরে যাত্রীদের সঙ্গে বাক বিতণ্ডার এক পর্যায়ে সাগর বলেন, ‘আমি লাব্বাইকের চেকার না। আমি এখানকার স্থানীয়। লাব্বাইকের একটা গাড়ি ট্রাফিকে ধরছে। এখানের চেকার ওই গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে গেছে। একটু অপেক্ষা করেন। তিনি আসলে জিজ্ঞাসা কইরেন।’
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর চেকার মো. রাসেল আসলে বেশি ভাড়া আদায় ও ওয়েবিলে ভাড়া আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওয়েবিলের গাড়ি চলে না। আমরা যাত্রীর হিসাব রাখি। যে বেশি ভাড়া আদায় করবে তার ডিউটি বন্ধ করে দেয়া হয়।’
তাহলে আপনার কাজ কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা রোডে এই কারণে থাকি যাতে কারও কাছ থেকে বেশি ভাড়া না নিতে পারে।’
তাহলে কীভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় হচ্ছে- এমন প্রশ্নে রাসেল বলেন, ‘রাস্তায় থাকা অবস্থায় তাদের আমরা কিছু বলতে পারি না। গাড়িটা স্টান্ডে পৌঁছালে পরে ব্যবস্থা নেই। অপরাধ করলেও চলন্ত গাড়ি থেকে তো স্টাফকে নামিয়ে দেয়া যায় না।’
তবে আগের মতোই চেকার রাসেল প্রতি গাড়ি চেক করার পরে ওয়েবিলে যাত্রী সংখ্যা লিখে সই করে ভাড়া কাটার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে নেমে যান।