চকবাজারের দেবিদ্বারঘাট এলাকার কামালবাগের চারতলা ভবনে আগুনের ঘটনায় মারা যাওয়া ছয়জনই হোটেল কর্মচারী। তারা সবাই ভবনটির নিচতলার বরিশাল হোটেলের কর্মচারী, হোটেলটির ঠিক উপরেই তাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। রাতভর কাজ শেষে সোমবার সকালে তারা একসঙ্গে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। এরপর অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান তারা।
নিহতদের শনাক্ত করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। ঘটনার পর থেকে এই ছয় কর্মচারীর কোনো খোঁজ মিলছিল না।
নিহতরা হলেন- স্বপন সরকার, আবদুল ওয়াহাব ওসমান, বিল্লাল সরদার, মোতালেব, মো. শরীফ ও মো. রুবেল।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরিশাল হোটেলটি ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। দুই শিফটে ভাগ করে কর্মচারীরা কাজ করেন। মারা যাওয়া ছয়জনই রোববার নাইট শিফটে কাজ করে সোমবার সকালে হোটেলের উপরে থাকার ঘরে ঘুমাতে গিয়েছিলেন।
স্বপন সরকারের গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায়। তার বাবার নাম রাকেশ সরকার, মা মালতী সরকার। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার বড় ভাই সজল সরকার ছোট ভাইয়ের মরদেহ শনাক্ত করেছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে দেখেই আমি চিনেছি। রোববার সারারাত ডিউটি করে সকালে ঘুমাতে গিয়েছিল। কে জানতো আমার ভাইয়ের এটাই ছিল শেষ ঘুম।’
ওসমানের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট থানার দক্ষিণ বড় কাসমা গ্রামে। ওসমান আবুল কালাম সরদার ও পেয়ারা বেগমের সন্তান। ওসমানের বড় ভাই আবদুল নিউজবাংলাকে জানান, ওসমান বরিশাল হোটেলের শুরু থেকেই কাজ করতেন। তার বয়স ২৭ বছর। ওসমান বরিশাল হোটেলে নাস্তা কারিগর। সারারাত কাজ করে সোমবার বেলা ১১টায় ওসমান হোটেলের উপরের ঘরে ঘুমাতে যান।
আবদুল বলেন, ‘আগুনের ঘটনা টিভিতে দেখে ওসমানের নম্বরে ফোন দিলে তা বন্ধ পাই। এরপর শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় আসি। বাবা, মা আর ভাইবোনের মধ্যে ওসমান আর আমি মিলেই সংসার চালাতাম। বরিশাল হোটেলে দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি পেত সে।’
ওসমানের এলাকার বড় ভাই রাব্বী ঘটনার পর ওসমানের মরদেহ শনাক্ত করতে পেরেছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওসমান আমার গ্রামের পরিচিত ছোট ভাই। আমি নিজেও চকবাজারে কাজ করি। ঘটনার পর ওসমানের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়ায় আমি এখানে চলে আসি৷ আগুন নেভানোর পর আমি সিঁড়ি দিয়ে হোটেলের উপরের ঘরে উঠে গিয়েই দেখি ওসমান আর বিল্লাল পাশাপাশি পড়ে আছে। আমি প্রায় সময়ই ওসমানের হোটেলে আসতাম, ওসমান আর বিল্লাল ঘনিষ্ঠ ছিল তাই ওদের দুইজনকেই চিনতে পেরেছি।’
বিল্লাল সরদারের বাড়ি বরিশালের মুলাদী থানার টুমচর গ্রামে। তার বয়স ৩৭ বছর। বিল্লাল বরিশাল হোটেলে এক বছর ধরে মেসিয়ার হিসেবে দৈনিক সাড়ে তিনশ টাকা মজুরিতে কাজ করতেন। গতরাতে তিনিও বরিশাল হোটেলে ডিউটি করেছেন।
বিল্লালের বড় বোন রুমা বেগম বলেন, ‘ছোট ভাই গ্রাম থেকে আমাকে ফোন করে জানায়, বিল্লালের দোকানে আগুন লেগেছে। তারপর আমি বিল্লালের মোবাইল বন্ধ পেয়ে এখানে চলে আসি। বিল্লালের স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তারা গ্রামের বাড়ি থাকে।’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে বিল্লালের মরদেহ শনাক্ত করেছেন তার ছোট ভাই আইয়ুব আলী।
মোতালেবের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার হিজলা থানার শংকরপাশা গ্রামে। তার বয়স ১৬ বছর। তার বাবার নাম মোস্তফা এবং মা মমতাজ বেগম। মোতালেব বরিশাল হোটেলের মেসিয়ার হিসেবে কাজ করত। তার পরিবারে বাবা-মা সহ আরও দুই ভাইবোন আছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে মোতালেব দ্বিতীয়।
সকালে মোতালেবের সঙ্গে ফোনে কথা হয় মামা নিজাম দপ্তরীর। তিনি বলেন, ‘সকালে আমি খবর নেয়ার জন্য মোতালেবকে ফোন দিয়েছিলাম। তখন সে ডিউটি শেষ করে গোসল সেরে ঘুমাতে যাচ্ছিল। এরপর টিভিতে খবর দেখে এই ঘটনা জনতে পারি। ওর ফোন এখনও বন্ধ।’
সন্ধ্যায় মর্গে মোতালেবের লাশ শনাক্ত করেন মামা নিজাম দপ্তরী। তিনি বলেন, ‘মোতালেবের মাথা আর শরীরের পুরো চামড়া পুড়ে গেছে। কিন্তু চেহারা চেনা যায়।’
১৬ বছর বয়সী শরীফের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা থানার তিতচর গ্রামে। তার বাবার নাম মিজান আর মায়ের নাম ফাহিমা। শরীফের আত্মীয় আবুল কাশেম জানান, বরিশাল হোটেলে কোরবানি ঈদের পর থেকে শরীফ কাজ শুরু করে। শরীফ দৈনিক ২০০ টাকা মজুরিতে ধোয়া-মোছার কাজ করত। শরীফের বাবার মেরুদন্ডের সমস্যা থাকায় কাজ করতে পারেন না। তাই সংসারের খরচ চালাতে এক মাস আগে তিনি বরিশাল হোটেলে কাজ করতে পাঠান শরীফকে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে শরীফ।
রুবেলের বয়স ২৮ বছর। তার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি থানার দক্ষিণ আকাল বরিশ গ্রামে। বাবার নাম সাত্তার হিলালু আর মায়ের নাম আনোয়ারা বেগম। তার স্ত্রী এবং সাড়ে তিন বছরের ছেলে সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকে। রুবেল গত দুই সপ্তাহ আগে বরিশাল হোটেলে মেসিয়ার হিসেবে কাজ নেন। তার মরদেহ শনাক্ত করেছেন বড় ভাই মোহম্মদ আলী। মোহম্মদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রুবেলের সঙ্গে আমার আরেক ভাইয়ের বেলা পৌনে ১২টায় কথা হয়। টেলিফোনে সে জানায়, রাতে ডিউটি শেষে সে এখন ঘুমাতে যাবে। কথা শেষ করার আগেই রুবেল কোনো একটা সমস্যার জন্য ফোন রেখে দেয়। এরপরই আমরা আগুনের ঘটনা শুনি আর রুবেলের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।’
এদিকে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ছয় জনের ময়নাতদন্ত শেষ হবে মঙ্গলবার। পাশাপাশি তাদের পরিচয় শনাক্তে পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করবে সিআইডি। যদি তাদের পরিচয় শনাক্ত নিয়ে কোনো দ্বিধা না থাকে তবে ময়নাতদন্তের পর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে৷
সোমবার সন্ধ্যায় ৬ জনের পরিবারই আলাদাভাবে মরদেহ শনাক্ত করতে পেরেছে। এক্ষেত্রে মরদেহ হস্তান্তরে কোনো জটিলতা তৈরি হবে কিনা জানতে চাইলে ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার জাফর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে পরিবারের সদস্যরা মরদেহ চিনতে পেরেছেন। ময়নাতদন্তের পর আবারও আরেকবার শনাক্তের সুযোগ দেয়া হবে। যদি তখনও তারা নিশ্চিত থাকেন তাহলে মরদেহ মঙ্গলবার হস্তান্তর করা হবে। আর সিআইডি যেহেতু ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ এবং টেস্ট করবে তাই তারা যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে ডিএনএ টেস্টের পর মরদেহ হস্তান্তর করা হতে পারে।’