রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডার যে ক্রেনটিতে করে উঠানো হচ্ছিল, দুর্ঘটনার পর পর তার চালক পালিয়ে গেছেন।
যিনি দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন, তিনিই ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন নাকি অন্য কেউ এই কাজ করছিলেন, সেই প্রশ্নেরও আপাতত জবাব নেই। পুলিশ বলছে, চালককে ধরা গেলেই সব প্রশ্নের জবাব মিলবে।
জাতীয় শোকদিবসে দুপুরে পুরান ঢাকায় প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে ছয় জনের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনায় পাঁচ প্রাণহানিতে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দুর্ঘটনায় ব্যথিত হয়েছেন। তিনি এক শোকবাণীতে এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে নিহতদের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন।
এর মধ্যে পুলিশ নিশ্চিত করেছে, ক্রেন দিয়ে গার্ডার তোলার সময় সেখানে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি না করেই কাজ করছিল কর্মীরা। আর কাত হয়ে থাকা ক্রেনটি গার্ডারের ভার নিতে পারেনি, নাকি অন্য কোনো সমস্যা হয়েছিল, সেটি জানা যায়নি এর চালক সেখানে না থাকায়।
ক্রেনটি কাত হয়ে গার্ডার গাড়ির ওপর পড়ে। ছবি: সংগৃহীত
দুর্ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে, সেটি উত্তরা পশ্চিম থানার অন্তর্গত। এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্রেন চালককে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি পলাতক আছেন।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান এই দুর্ঘটনা নিয়ে তিনটি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথমত. সেখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল কি না, দ্বিতীয়ত. ক্রেন ঠিক আছে কি না, ক্রেন যিনি অপারেট করছিলেন, তার লাইসেন্স আছে কি না। তিনি অভিজ্ঞ কি না এবং তৃতীয়ত. গার্ডারের যে ওজন এবং ক্রেনের যে সক্ষমতা, সেটা ঠিক আছে কি না।
তিনি বলেন, ‘এই তিনটা জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তের মাধ্যমে এগুলো বের করতে হবে।’
এর মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওসি মোহসীন। এ কারণেই ক্রেনটি তোলার সময় প্রাইভেট কারটি এর প্রভাবিত এলাকায় চলে যায়। আর ভারী গার্ডারের ওজনে একেবারে পিষ্ট হয়ে যায়।
উত্তরা পুলিশের একজন কর্মকর্তার কাছে অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের তোলা বাকি প্রশ্নগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ক্রেন চালককে খুঁজে বের করা কঠিন কিছু হবে না। তাকে পাওয়া গেলেই সব প্রশ্নের জবাব মিলবে।’
উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (অপারেশন) পার্থ প্রতীম ব্রহ্মচারী বলেন, ‘যিনি ক্রেনের প্রকৃত চালক, তিনিই সেটি চালাচ্ছিলেন কি না সেটি তদন্ত সাপেক্ষ।’
দুর্ঘটনার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এসেছিলেন বলেও জানান তিনি।
দুর্ঘটনার পর চাপা পড়াদের উদ্ধার করছেন পুলিশ ও স্থানীয়রা। ছবি: সংগৃহীত
বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মনে করেন, ক্রেন চালক ছাড়াও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত অবহেলা এই দুর্ঘটনার কারণ।
তিনি বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস হচ্ছে আমাকে সেই জায়গাতে আগেই কর্ডন বা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। ওই বেষ্টনীর মধ্যে যেন পথচারী বা কোনো যানবাহন ঢুকতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্বও কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।’
‘তারা ঠিক মতো প্র্যাকটিস করছে কি না, এটার নজরদারি বা তদারকির দায়িত্ব তো বাস্তবায়নকারী সংস্থার। এই ধরনের প্রকল্পের সুপারভিশনের দায়িত্ব আরেক সংস্থার থাকে। তার মানে কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেটার জন্য সুপারভিশন সংস্থা আছে, আমাদের বাস্তবায়নকারী সংস্থা আছে, এটার একটা সমন্বয় দরকার।’
ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি একেবারে বিরল নয়। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে একই প্রকল্পের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় এক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন।
ঢাকার তেজগাঁও ও মালিবাগ মোড় এবং চট্টগ্রামেও প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে ২৯ জনের প্রাণহানি হয়।
এসব ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা গণমাধ্যমে আসেনি।