গুমের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সরকারের কাছে গুম হওয়া যে ৭৬ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছিল, তাদের ব্যাপারে সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটকে অবগত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
সচিবালয়ে মন্ত্রীর দপ্তরে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, ‘আমাদের ৭৬ জনের মিসিং বা ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পারসনের তালিকা দেয়া হয়েছিল, আমাদের বলা হয়েছিল। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি এ ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জন তাদের বাড়িতেই আছেন। দুজন আছেন জেলখানায়।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তাকে বলেছি, আমাদের দেশে তিনটি কারণে ডিসঅ্যাপিয়ার হয়: প্রথম কারণ হচ্ছে ঘৃণ্য অপরাধ যারা করে, ভিডিওর মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছি, পুলিশকে পিটিয়েও তারা হত্যা করেছে। আমরা এটাও দেখিয়েছি, কীভাবে তারা মানুষের সম্পদ ধ্বংস করেছে। যারা এগুলো করেছে, তারা সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছে। তারা ভারত কিংবা মিয়ানমার কিংবা অন্য কোনো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। বাকিগুলো সব আমাদের সঙ্গেই আছে।’
বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (মিশেল) আগেই আমাদের কিছু লিখিত প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছিলেন, যেগুলো নিয়ে তিনি আলাপ করতে চান। সেগুলো সবকিছু তাকে (বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে)... আমাদের ভূমিকা, আমাদের কীভাবে চলছে, আমাদের সরকারিভাবে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসা ছিল, অনেকে মিসিং হয়ে যায়, আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন। অনেক নৃশংসতা বাংলাদেশে হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা কী করেছি।
‘আমরা তাকে বলেছি, আমাদের জাতির পিতা যিনি আমাদের দেশটি স্বাধীন করেছেন, যেখানে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছে, যেখানে দুই লাখ মা-বোনের চরম আত্মত্যাগ রয়েছে, স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। কাজেই সব সময় আমাদের দেশে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত লেগেই আছে।’
তিনি বলেন, ‘অন্ধকার যুগ পেরিয়ে যার ধমনিতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ চলছে। আমরা সেই অন্ধকার থেকে বাংলাদেশ তৈরি করেছি। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন। আমাদের সংবাদপত্র সব স্বাধীন। আমরা বলেছি, আমাদের এখানে ১ হাজার ২৬৫টি স্বীকৃত দৈনিক সংবাদপত্র। সব মিলিয়ে সংবাদপত্র আছে ৩ হাজার ১৫৪টি। মোট টিভি চ্যানেল আছে ৫০টি। তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
‘এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়ে তারা যা ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে, মতামত প্রকাশ করে থাকে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। আমরা বলছিলাম এটার সবচেয়ে বড় শিকার হলেন নারীরা, শিশুরা। খুব কমসংখ্যক, ৩ শতাংশের বেশি নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে মামলা হয়েছে। এদের নিরাপত্তার জন্যই আইনটি ছিল। আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটাকে আরেকটু সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে, আমরা সেটাই করছি। এখন কেউ মামলা করলে আমরা দেখি সে অপরাধটা করেছে কি না, অপরাধ করলে মামলাটা নেয়া হয়। তিনি (মিশেল) বলেছেন, আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছি।’
বৈঠকে রোহিঙ্গাদের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কথা বলেছি। তারাও এদের দুঃখের-কষ্টের কথা স্বীকার করলেন। তারা জানে আমরা মাদক তৈরি করি না। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। ইয়াবা, আইস মিয়ানমার থেকে আসে এবং অন্যান্য দেশ থেকে কোকেনসহ বিভিন্ন মাদক আসে।
‘সেগুলো বন্ধ করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের সঙ্গে বহুবার বসেছি। তারা (মিয়ানমার) সব সময় অনেক অঙ্গীকার করেছে, সেগুলোর একটাও তারা রাখেনি। তারা (মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের প্রতিনিধি দল) সব বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘তারা বলছেন, তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন। জাতিসংঘের সব সংস্থাই বলছে, আমাদের সঙ্গে সবারই কথা হচ্ছে। মিয়ানমারের সরকারের অবস্থা ভালো না, এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না– এটাই তারা বলে যাচ্ছেন, বলছেন।
‘মাইনরিটির প্রসঙ্গটিও এসেছে: নড়াইলের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনা। আমরা বলেছি, এগুলো ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যেসব কমেন্ট করা হয়েছে, এগুলো দেখেই। যেখানে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেখানেই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছি। মামলা হয়েছে এবং তাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারা বসে ওখানে একটা শান্তির ব্যবস্থা আমরা করেছি। সবকিছু তারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছেন। যে অ্যাকশনগুলো আমরা নিয়েছি, সেগুলোর তারা প্রশংসা করেছেন।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নেত্র নিউজ সব সময় ভুয়া নিউজ দিয়ে থাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। আমরা এগুলোকে নিউজ বলে মনে করি না। আমাদের দেশের যে ঘটনা, আমাদের দেশের মিডিয়া ফ্রি। তারা যেকোনো সংবাদ সব সময়ই প্রকাশ করে থাকেন। আমরা কোনো মিডিয়ার ওপর কোনো সেন্সর করি না। কাজেই কোথাকার কোন নিউজ কী বলল, আমরা সেগুলোর কোনো বাস্তবতা খুঁজে পাই না।’
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘গুম দিবস যারা করেন, তারা একটা উদ্দেশ্য নিয়েই করেন। তারাও জানেন, তাদের ছেলেটি কিংবা ভাইটি কিংবা তাদের মেয়েটি কোথায় আছেন। আমরা এটুকু বলতে চাই যে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাদের নিয়ে যায়, তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে সাবমিট করতে হয়। কেউ যদি ইচ্ছে করে গুম হয়ে যায়, কেউ যদি কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে বিদেশে চলে যায়, কিংবা সমুদ্রপথে যদি চলে যায়, যেটাকে আমরা মানব পাচার বলি, সেখানে চলে যায়, আমাদের তো তাকে বের করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। কাজেই যারা এগুলো বলছেন, এগুলো আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী দেখছেন। আমরা যাকেই খুঁজে পাব, তাকে আমরা প্রকাশ করে দেখাব।’
‘গুম দিবস’ যারা পালন করেন, তারাও জানেন তারা কোথায় আছেন? – সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘না, না আমি সেটা বলতে চাইনি। আমি বলতে চাচ্ছি, তারাও জানেন, তারা কোথায় গিয়েছেন। অনেকেই জানেন, সবাই জানেন এমন কথা বলব না।
‘কেউ যদি ইচ্ছে করে আত্মগোপন করে থাকে, আমরা কেন, কেউই এই আত্মগোপন বের করতে পারবে না যে পর্যন্ত তারা স্বেচ্ছায় না চলে আসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্ডারগুলোতে অনেক জায়গা দিয়ে তারা খুব ইজিলি চলে যেতে পারে। আমরা এটিই বলতে চাই। দ্বিতীয় বিষয় সমুদ্রপথ দিয়েও চলে যেতে পারে। যে কোনোখানে তারা চলে যেতে পারে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু বিচার বিভাগ স্বাধীন, কাজেই বিচারকাজকে এড়ানোর জন্যই তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেগুলোর নমুনা আমরা তাদের দিয়েছি, আসলে তারা কী ধরনের ক্রাইম করেছে। আর একটি বিষয় আমরা তাদের বলেছি, যারা দেউলিয়া হয়ে যায় পাওনাদার বেড়ে যায়, ফলে পাওনাদারদের এড়ানোর জন্য গায়েব হয়ে যায়, আত্মগোপনে যায়। আমরা যখন অভিযোগ পাই, তখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের খুঁজে বের করে আনলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। আবার পারিবারিক কারণেও অনেকেই গুম হয়ে যায়।’