পণ্যবাহী ট্রাককে টার্গেট করে পিছু নেয় যাত্রীবাহী বাস। সুবিধাজনক নির্জন স্থানে বাস দিয়ে ট্রাকের গতিরোধ করা হয়। ট্রাকে থাকা চালক-সহকারীকে বেধড়ক মারধর করে ছিনিয়ে নেয়া হয় ট্রাকের নিয়ন্ত্রণ। ট্রাকের চালক ও সহকারীকে হাত-মুখ বেঁধে উঠিয়ে নেয়া হয় বাসে। তারপর পণ্যবাহী ট্রাক একদিকে, বাস অন্যদিকে।
দেড় বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ভুলতা, ঢাকা-সিলেট ও আড়াইহাজার-নরসিংদী মহাসড়কে বাস দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ ভ্যান ও কাভার্ড ভ্যানে ডাকাতি করে আসছিল একটি চক্র।
এই ডাকাত চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। উদ্ধার করা হয়েছে একটি ডিমবোঝাই পিকআপ ভ্যানের চালক ও সহকারীকে।
র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১-এর একটি দল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও বন্দর থানা এলাকা থেকে মহাসড়ক ডাকাতির সময় ছয় ডাকাতকে আটক করে শুক্রবার রাতে। আটক ব্যক্তিরা হলেন মুসা আলী, নাঈম মিয়া, শামিম, রনি, আবু সুফিয়ান ও মামুন।
তাদের কাছ থেকে দুটি চাপাতি, একটি চায়নিজ কুড়াল, একটি ছোরা ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি বাস জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া পিকআপ ভ্যানে ডাকাতির পর বাসে উঠিয়ে নেয়া পিকআপ ভ্যানের চালক ও সহকারীকে উদ্ধার করেছে র্যাব।
শনিবার দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানিয়েছেন ফোর্সের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, নরসিংদী-সায়দাবাদ সড়কে চলাচল করা যাত্রীবাহী একটি বাস দিয়ে রাতের বেলা ডাকাতি করে আসছিল চক্রটি। ‘যুব কল্যাণ এক্সপ্রেস লিমিটেড’ নামে কোম্পানির একটি বাস ব্যবহার করে তারা ডাকাতি করত। মালিক ডাকাতির বিষয়ে না জানলেও এর চালক এবং সহকারী এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আটক ছয়জনের মধ্যে বাকিরা বিভিন্ন পেশার আড়ালে এই ডাকাতিতে জড়িত।
র্যাব জানিয়েছে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় র্যাব তাদের টহল জোরদার করেছে। এরই অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতা গোলাকান্দাইল এশিয়ান হাইওয়েতে র্যাব-১১ এর টহল চলাকালে একটি ডিম বোঝাই পিকআপের গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় এর গতিরোধ করা হয়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে পিকআপ থেকে দুই ব্যক্তি পালানোর চেষ্টা করলে তাদের আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে কথাবার্তা ও আচরণে অসংলগ্নতা প্রকাশ পাওয়ায় তাদের তল্লাশি করা হয়। তাদের কাছ থেকে একটি চাপাতি ও একটি চায়নিজ কুড়াল উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আটক দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্য। তারা ডাকাতির উদ্দেশ্যে একটি বাসে করে ভুলতা থেকে রূপসা যাওয়ার পথে এশিয়ান হাইওয়েতে ওই ডিমবোঝাই পিকআপের পিছু নেয়। একপর্যায়ে ভুলতা-রূপসী সড়কে পিকআপটির সামনে বাস দিয়ে রাস্তা আটকে পিকআপের গতিরোধ করে তারা।
‘এরপর পিকআপের ড্রাইভার ও তার সহকারীকে ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পিকআপটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং ড্রাইভার ও তার সহকারীকে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে মারপিট করে ও বাসে উঠিয়ে নেয়। এরপর ডাকাত দলের সরদার মুসা ও তার প্রধান সহকারী নাঈম পিকআপটি নিয়ে গাউছিয়া-মদনপুরমুখী রাস্তায় নিয়ে যায়। বাকি সদস্যরা পিকআপের চালক ও হেলপারকে বাসে করে নিয়ে যায় মদনপুরের দিকে।’
খন্দকার আল মঈন জানান, আটক দুজনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিকআপের ড্রাইভার ও হেলপারকে উদ্ধারের উদ্দেশে র্যাবের একটি দল মদনপুর পৌঁছায়। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার মদনপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে যুব কল্যাণ এক্সপ্রেস লিমিটেডের বাসটি আটক করা হয়। এ সময় র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাত দলের সদস্যরা দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে র্যাব সদস্যরা চারজনকে আটক করেন। আরও চার-পাঁচজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বাসের ভিতর থেকে হাত-পা ও চোখমুখ বাঁধা অবস্থায় পিকআপের ড্রাইভার ও তার সহকারীকে উদ্ধার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে ১০-১২ জনের এই ডাকাত দলটি বেশ কয়েক বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার এলাকায় বিভিন্ন মহাসড়কে নিয়মিত ডাকাতি করে যাচ্ছিল। তারা পেশায় কেউ পোশাককর্মী, চালক, হেলপার আবার কেউ রাজমিস্ত্রি ও কাপড়ের দোকানের কাটিং মাস্টার। দিনে নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত থাকলেও বিভিন্ন সময় তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে থাকে।
খন্দকার মঈন জানান, চক্রটি তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ডাকাতি করে এবং ডাকাতির কাজে একটি বাস ব্যবহার করে।
দলনেতা মুসার নির্দেশে প্রথম দলটি ডাকাতির জন্য বিভিন্ন পোশাক কারখানার পণ্যবাহী ট্রাক ও মহাসড়কে চলাচলকারী পণ্যবাহী যানবাহন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং ডাকাতির জন্য সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করে।
দ্বিতীয় দলটি বাস নিয়ে মহাসড়কে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে। তারা টার্গেটকৃত পণ্যবাহী যানবাহনের পিছু নেয়। বাহনের গতিরোধ করে সেটির চালক ও হেলপারকে বাসে তুলে নেয়া হয়। তারপর হাত-পা ও চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় মহাসড়কের নির্জন স্থানে ফেলে দেয়া হয়।
তৃতীয় দলটির নেতৃত্ব দেন দলনেতা মুসা নিজে। তিনি ছিনতাইকৃত পণ্যবাহী গাড়িটি চালিয়ে ডাকাতি করা পণ্য পূর্ব নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যান এবং তা আনলোড করেন।
র্যাব জানায়, আটক ছয়জনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।