বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত ভেঙে জ্বালানি আমদানি করছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ। বলেছেন, ডিজেলের দর লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর পরও তাদের লোকসান হচ্ছে।
২০১৪ সাল থেকে টানা সাত বছর বিপিসির যে পরিমাণ মুনাফা হয়েছে, তার আগের ১৪ বছরে এর চেয়ে বেশি লোকসান ছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, মুনাফার টাকায় আগের লোকসান সমন্বয় করা হয়েছে।
তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানোর পর বিপিসির ২০১৪ সালের পর থেকে মুনাফায় থাকা, বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের বিপুল পরিমাণ স্থায়ী আমানতের বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর এ নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে বুধবার বিকেলে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিপিসির চেয়ারম্যান।
গত ৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দর লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করে। অকটেন প্রতি লিটার ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ ও পেট্রল ৮৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এই দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণে বিপিসির বিপুল পরিমাণ লোকসান হচ্ছিল। গত কয়েক মাসে লোকসান ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।
এরপর একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হয় ২০১৪ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মুনাফা ও করসহ লাভ হয় ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এই সংবাদ প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ প্রশ্ন করতে থাকে, আগের মুনাফা থেকে বর্তমানের লোকসান সমন্বয় করা হলো না কেন।
অন্য একটি জাতীয় দৈনিক জানায়, সরকারি সংস্থার মধ্যে বিপিসির ব্যাংকে স্থায়ী আমানত সবচেয়ে বেশি। তাহলে তারা কেন লোকসানের কথা বলছে।
এই দুটি বিষয়েই ব্যাখ্যা দেন বিপিসির চেয়ারম্যান।
বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ। ছবি:সংগৃহীত
তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে সাত বছর মুনাফা করলেও এর আগের ১৪ বছর টানা লোকসান দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত জ্বালানি খাতে ক্রমাগত লোকসান গুনতে হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার ৫ কোটি টাকা। ফলে ভর্তুকি হিসেবে সরকার বিভিন্ন সময় বিপিসিকে ৪৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা দেয়। ফলে সাত বছরে মুনাফা করলেও ওই সময়ে আরও ৮ হাজার ১২৭ কোটি টাকার ঘাটতি ছিল, যা পরে বিপিসির মুনাফার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।’
ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের বিষয়ে এ বি এম আজাদ বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় সব ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে বিপিসিকে আমদানি ব্যয় মেটাতে হচ্ছে।’
তেলের আমদানি ব্যয় কত
এ বিষয়েও একটি হিসাব দিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান জানান, বর্তমান দরে ডিজেল বিক্রি করে তাদের লিটারে লোকসান হচ্ছে ৬ টাকা। তবে অকটেনে মুনাফা হচ্ছে ২৫ টাকা।
তিনি জানান, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রতি লিটার ডিজেলে ১২০ টাকা খরচ হচ্ছে বিপিসির।
বিপিসি প্রধান বলেন, ‘২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের প্রতি ব্যারেল ডিজেল কেনার খরচ পড়ত প্রতি ব্যারেলে ৯৬ দশমিক ৯৫ ডলার। প্রতি লিটারে আমরা যখন এটাকে কস্টিং করি, প্রতি লিটার পরে ৮৩ টাকা ৬ পয়সা। ওই সময়ে বিপিসি বিক্রয় করত ৮০ টাকা করে। সেখানে লিটারে ৩ টাকার মতো লোকসান ছিল।’
‘ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন প্রতি ব্যারেল ১০৮ ডলার ৫৫ সেন্ট, সেটাকে টাকায় প্রতি লিটারে কনভার্ট করলে হয় ৮৯ টাকা ৮৫ পয়সা। তখনও বিপিসি বিক্রি করেছে ৮০ টাকা লিটার। যে কারণে ওই মাসে ৯ টাকার মতো লোকসান গুনতে হয়েছে।
‘এ ফর্মুলায় গত জুলাই মাসে প্রতি ব্যারেল মূল্য ছিল ১৩৯ দশমিক ৪৩ ডলার, টাকায় প্রতি লিটারে কনভার্ট করলে খরচ পড়ত ১২২ টাকা ১৩ পয়সা। তখনও ওই তেল বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। এভাবে তেলের দাম বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে প্রতি লিটারে লোকসান এসে দাঁড়িয়েছিল ৪২ টাকা ১৩ পয়সা।’
এফডিআর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে
ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ স্থায়ী আমানত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে করা হয়েছে বলে জানান বিপিসি চেয়ারম্যান। জানান, তারা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ১১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন।
এর মধ্যে আছে ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানো। এতে ব্যয় হবে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে বিপিসির মুনাফার একটি অংশ এফডিআর করা হয়। বিপিসি তার অর্থ কোনো না কোনো ব্যাংকের হিসাবের বিপরীতে রাখতে হয়। প্রকল্পের যে অর্থগুলো, সেগুলো প্রকল্পের নামে এফডিআর খুলে রাখা হয়।’
জ্বালানির দর বৃদ্ধি এই উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাড়ানো হয়নি বলেও জানান তিনি।
দেশে উৎপাদন হলেও পেট্রল ও অকটেনের নাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ক্রুডের কারণে পেট্রল ও অকটেনের দাম বাড়ে। সুতরাং পেট্রল ও অকটেনের দাম কৌশলগত কারণে বাড়াতে হয়েছে।’
বর্তমানে দেশে ৩০ দিনের ডিজেল এবং ১৮ দিনের পেট্রল ও অকটেন মজুত আছে বলেও জানান বিপিসি চেয়ারম্যান।