বাস ভাড়ায় নগরবাসী কতটা ঠকছে, সেটি এবার স্বচক্ষে দেখলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা কাজী জাফরউল্লাহ। যতটা ভাড়া হওয়া উচিত, তিনি দিয়েছেন তার দেড়গুণেরও বেশি।
এরপর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন অন্যদের সঙ্গে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, মানুষের কষ্ট হচ্ছে, সরকার যেন ব্যবস্থা নেয়।
বছরের পর বছর ধরে নগরবাসী তারই মতো ঠকছেন, কখনও কখনও ঠকার হার তার চেয়ে বেশি। বাস ভাড়া যত বাড়ে, নগরবাসীর নিত্যদিনের ক্ষতি তত বাড়ে।
ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর বিআরটিএ হিসাব করে দিয়েছে ভাড়া হবে কিলোমিটারে আড়াই টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা হিসেবে, চার কিলোমিটার যাওয়া যাবে এই টাকায়।
তবে কিলোমিটার হিসেবে ঢাকায় ভাড়া নেয় না বাস কোম্পানিগুলো। যাত্রী ঠকাতে কয়েক বছর ধরে চালু হয়েছে ওয়েবিল নামে এক ধরনের পদ্ধতি। কোনো কোনো বাসে দুই কিলোমিটার পরপর বসানো হয়েছে ওয়েবিল, কোথাও কোথাও আড়াই বা তিন কিলোমিটার পরপর।
এক ওয়েবিল থেকে আরেক ওয়েবিল পর্যন্ত কোনো বাস আগে নিত ১০ টাকা, কোনো বাস ১৫ টাকা। এই হিসাবে ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ৫ টাকাও পড়ে। এখন ভাড়া বাড়ানোর পর আদায় চলছে ১৫ টাকা করে। যে পথের দূরত্বে আগে আদায় হতো ১৫ টাকা, এখন নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা, যেখানে নেয়া হতো ২০ টাকা, এখন নেয়া হচ্ছে ৩০-এভাবেই চলছে।
রাজধানীতে রাইদা পরিবহনের ভাড়া আদায়ের পরিমাণ ও পথের দূরত্ব। ছবি: নিউজবাংলা
তবে আগে যে ভাড়া নেয়া হতো, সেটিও যে সরকার নির্ধারিত হার, এমন নয়। বরং বর্তমান যে হার ঘোষণা করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আদায় হতো আগেই।
এই বিষয়টি না জানার কারণে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফররুল্লাহ যতটা ঠকেছেন ভেবেছেন, আসলে ঠকেছেন তার চেয়ে বেশি।
তিনি মিরপুরের পূরবী সিনেমা হলের সামনে থেকে বাসে উঠে নামেন বনানীর কাকলী মোড়ে। এই পথের দূরত্ব হয় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার। নির্ধারিত ভাড়া হয় ১৭ টাকা।
কিন্তু আগে থেকে আদায় করা হতো ২০ টাকা। জাফরউল্লাহকে দিতে হয়েছে ৩০ টাকা। তিনি ভেবেছেন ঠকেছেন ১০ টাকা, আসলে ঠকেছেন ১৩ টাকা।
সরকার সর্বোচ্চ ভাড়া ঠিক করেছে কিলোমিটারপ্রতি আড়াই টাকা। আওয়ামী লীগ নেতা দিয়েছেন ৪ টাকা ১১ পয়সা হারে।
নিউজবাংলাকে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘সরকার ২০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি অনুমোদন করেছে। তার মানে ২০ টাকার জায়গায় ৩০ টাকা নেয়া তো ৫০ শতাংশ বেশি হলো। এটা তো উচিত না। দেখলাম তো যাত্রীদের যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে।’
এই প্রতারণার বিষয়টি জেনে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন- জানতে চাইলে জাফরউল্লাহ বলেন, ‘পার্টি অফিসে বসে আমাদের সাধারণ সম্পাদক সাহেবকে (সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের) জানিয়েছি। সেখানে সেন্ট্রাল কমিটির অনেকে ছিলেন। তাদের সামনে তাকে আমি অবহিত করেছি। এরপর যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমার তো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই।’
-সড়কমন্ত্রী কোনো জবাব দিয়েছেন?
জাফরউল্লাহ বলেন, ‘কাদের সাহেব ধৈর্য্যের সঙ্গে সময় দিয়ে আমার কথা শুনলেন। এটার ওপর আরও বিভিন্ন লোক মন্তব্য করেছেন, কাদের সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটা যে সত্য সেটা এখন মনে হয় তিনি বুঝতে পারছেন।’
জাফরউল্লাহ ভাড়া ‘কমই দিয়েছেন’
আওয়ামী লীগ নেতা ভাড়ার যে অনিয়ম দেখে সড়কমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তিনি যতটা ঠকেছেন, নগরবাসী ঠকছেন আরও বেশি।
মোহাম্মদপুর থেকে বনশ্রী হয়ে চলাচলকারী স্বাধীন পরিবহনে কোনো কোনো গন্তব্যে ৬ টাকা কিলোমিটার পর্যন্ত ভাড়া আদায় করছে। এমনকি সরকারি সংস্থা রাজউক রাজধানীর হাতিরঝিলে যে বাস পরিচালনা করে, সেখানেও নেয়া হয় বাড়তি ভাড়া।
এফডিসি বাসস্টপ থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত ৩ কিলোমিটারে এতদিন ভাড়া ছিল ১৫ টাকা, এখন করা হয়েছে ২০ টাকা। আগে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া পড়ত ৫ টাকা, এখন ৬ টাকা ৬৬ পয়সা।
পথের দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া অনেক বেশি আদায় করার অভিযোগ রয়েছে স্বাধীন পরিবহনের বিরুদ্ধে। ছবি: নিউজবাংলা
এফডিসি বাসস্টপ থেকে রামপুরা পর্যন্ত আগে ভাড়া নেয়া হতো ২০ টাকা, এখন করা হয়েছে ২৫ টাকা। ৪ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরত্বে আগে ভাড়া পড়ত ৪ টাকা ৭৬ পয়সা, এখন পড়ছে ৫ টাকা ৯৫ পয়সা।
এমনকি মধুবাগ পর্যন্ত দূরত্ব কম হলেও ভাড়া নেয়া হচ্ছে একই।
রামপুরা থেকে মধুবাগ পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটারের জন্যও আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা, যা আগে ছিল ১৫ টাকা।
আগে ভাড়ার হার ছিল ৪ টাকা ১৬ পয়সা, এখন হয়েছে ৫ টাকা ৫৫ পয়সা।
বিআরটিএ বলেছে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা, কিন্তু রাজউক করেছে দ্বিগুণ।
‘কোম্পানি উঠাইয়া দিলে আমরা ওয়েবিলে ভাড়া নেব না’
কাজী জাফরুল্লাহ যে পথ ধরে বাসে চড়েন, সেই পথে চলে রবরব পরিবহন, যেটি গাবতলী থেকে মেরাদিয়া বাজার পর্যন্ত যায়।
এই বাসে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ইসিবি পর্যন্ত ৪.২ কিলোমিটার পর্যন্ত ভাড়া হতে পারত ১০ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু নিচ্ছে ১৫ টাকা।
কালাপানি থেকে বাড্ডা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারে ভাড়া নিচ্ছে ৩৫ টাকা। বেশি নিচ্ছে ১০ টাকা, প্রতি কিলোমিটারে পড়ে সাড়ে তিন টাকা।
কালশী থেকে তিতুমীর কলেজ পর্যন্ত ৮.৪ কিলোমিটারে ভাড়া আসে ২১ টাকা। আদায় হচ্ছে ২৫ টাকা।
রাজধানীতে চলাচলকারী রবরব পরিবহনের বাস। ছবি: নিউজবাংলা
রবরব গাড়ির ড্রাইভার মো. ইসমাইল বলেন, ‘আড়াই টাকা হিসাব করলে হয় না মামা। চেকে যে টাকা আসে সেটা নেই।’
ওয়েবিল তো অবৈধ। তাহলে এভাবে ভাড়া নিচ্ছেন কেন- জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, ‘কোম্পানি উঠাইয়া দিলে আমরা ওয়েবিলে ভাড়া নেব না। তারা যেমনে চালায় আমরা সেইভাবে চলি। তারা চেকে চেকে টাকা নিচ্ছে। আমরা সেইভাবেই ভাড়া কাটতেছি।’
এই চালকের বক্তব্যে আরও একটা বিষয় উঠে এসেছে, সেটি হলো, যারা প্রতিবাদ করছে, তাদের কাছ থেকে ভাড়া কম নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘কারও কাছ থেকে পাঁচ টাকা বেশি, কারও কাছ থেকে কম নিচ্ছি।’
এই বাসে যিনি ভাড়া কাটছেন, তার কাছে জানা গেল, এই রুটে ওয়েবিল বসিয়ে ছয়টি চেক হিসেবে ভাড়া আলাদা করা হয়েছে। প্রতি চেকে ভাড়া ছিল ১০ টাকা। এখন করা হয়েছে ১৫ টাকা।
৫০ শতাংশ বাড়ানোর পর আগে ভাড়া ছিল ৬০ টাকা, এখন হয়েছে ৯০ টাকা। বিআরটিএ যে ভাড়ার চার্ট দিয়েছে, তাতে ভাড়া আসে ৬৬ টাকা।
এই পরিবহনশ্রমিক বলেন, ‘মালিকপক্ষ এইভাবেই চালাচ্ছে। আমাদের কাজ ভাড়া নেয়া। আমাদের থেকে যাত্রী হিসাব করে টাকা নেয়।’