শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে প্রতিদিনই নদীতে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, বাড়িঘর ও গাছপালা। বিলীন হয়েছে দক্ষিণ নারায়ণখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও।
এমন অবস্থায় চরম আতঙ্ক আর হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন এলাকাবাসী।
শেরপুরের নকলায় নারায়ণখোলা এলাকায় গত বছরও কয়েক দফায় ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙনে শত শত পরিবারের বসতভিটা, মসজিদ, কবরস্থানসহ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অনেকের জায়গা-জমি নদীতে বিলীন হওয়ায় মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। পরিবারসহ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে না পেরে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এ বছরও দ্বিতীয় দফায় ব্রক্ষপুত্রে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে গত এক সপ্তাহেই অন্তত অর্ধশত একর আবাদী জমি, ২০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীতে হারিয়ে গেছে প্রায় এক কিলোমিটার কাঁচা সড়ক।
ভাঙনের মুখে নারায়ণখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছবি: নিউজবাংলাঅন্যরাও শঙ্কায় আছেন, কখন তাদের বাড়িঘর ও জমি নদীগর্ভে চলে যায়। গত ২০ বছরে নকলার নারায়ণখোলা এলাকায় নদীগর্ভে চলে গেছে সহস্রাধিক একর আবাদী জমি, শ শ বাড়িঘর। কিন্তু ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
স্থানীয় নিজাম উদ্দিন খান বলেন, ‘মনে হয় আমাদের এ এলাকাটাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তা না হলে একটা ব্যবস্থা নেয়া হতো। আমাগোর ফসলি জমিজমা সব নিয়ে গেছে। আমরা এহন কি করি। এ পর্যন্ত আমার ৫০ শতাংশ জমি নিয়ে গেছে এ নদী ভাঙনে।’
রত্না বেগম বলেন, ‘এলাকার সব নদীয়ে ভাইঙা নিয়া যাইতাছে গা। স্কুলডাও মনে হয় কয়দিনের মধ্যে নিয়ে যাবো গা। পুলাপান কই পড়ামু। নদীভাঙন ঠেহানোরও কেউ নাই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাতে আমাদের নদী ভাঙন রোধ করার একটা ব্যবস্থা নেন।’
নাছিমা বেগম নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার স্বামীর যা জমি আছিল সব শেষ। এহন আর আবাদ ফসল কইরা খাওয়ার কিছু নাই। বাড়ি ভিটা ডাই আছে এহন। আস্তে আস্তে নদী ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির সামনে আইয়া পড়ছে। সব নিয়া বাপের বাড়ি যাওন লাগবো গা কয়দিন পর।’
বিলীন হওয়ার পথে নারায়ণখোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়টি। এ বিদ্যালয়টির একটি ভবন নদীতে ভেঙেছে গতবছর। এরপর থেকে পুরাতন টিনশেডে চলছে লেখাপড়া। কিন্তু এ দফায় স্কুলটির মাঠের জমি চলে গেছে নদীগর্ভে। যে কোন সময় নদী ভেঙে নিয়ে যেতে অবশিষ্ট জমি ও ঘর। এতে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতে পারে এ এলাকার শিশুরা।
স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী লিসান আহমেদ বলেন, ‘আমগোর স্কুল নদীতে ভাইঙা যাবোগা, ডরে আব্বা-আম্মায় স্কুলে পাঠাবার চায় না। আমগোর স্কুলটারে রক্ষা করার জন্য সরকারিভাবে যদি কোন বাঁধ না দেয়া যায়, তাইলে আমরা পড়বার পামু না। তা না হলে আমরা কই পড়বার যামু?’
আরেক শিক্ষার্থী রিমা খাতুন বলেন, ‘আমাদের স্কুলের একটি ভবন আগেই নদী নিয়ে গেছে। এখন স্কুল মাঠটিও নদীয়ে ভেঙে নিয়ে গেছে প্রায়। আমরা খেলতে পারি না। আমাগো স্কুলডারে বাঁচানোর জন্য দাবি করছি।’
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শামছুন নাহার বলেন, ‘এ নদী বিদ্যালয়ের প্রধান একটি বিল্ডিং ভেঙে নিয়ে গেছে তিনবছর আগে। এর আগেও আরও দুইবার স্থানান্তরিত হয়েছে এ বিদ্যালয়। এবার বিদ্যালয়ের একেবারেই দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে নদী। এখন রিস্কের মধ্যে ক্লাস করতে হচ্ছে। আর স্কুল মাঠও আস্তে আস্তে নদী নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা খেলাধুলাও করতে পারে না। ভয়ে শিক্ষার্থীও আসতে চায় না স্কুলে। তাই একটা স্থায়ী বাঁধের ব্যবস্থা করার দাবি জানাই সরকারের কাছে। এখনই ভাঙনরোধ করা প্রয়োজন।’
একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে এলাকায় বিভিন্নসময় মানববন্ধনও করেছে এলাকাবাসী। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার ৮ নং চরঅষ্টধর ইউনিয়নের দক্ষিণ নারায়ণখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙনসহ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কয়েক শতাধিক ভাঙন কবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী মানববন্ধন করে।
সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন স্থানীয়রা। তারা দাবি জানান এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষার।
স্থানীয় আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের এখানে গোরস্থান আছে। গত ৫-৭ বছর আগে আমার বাপ মারা যাওয়ায় তারে বাড়ির পাশে কবর দিয়েছি, এহন ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙন এমনভাবে বাড়ছে আমার বাপের স্মৃতিটুকু, তার কবরটাও হয়তো শেষ রক্ষা করতে পারুম না।’
এ বিষয়ে নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বুলবুল আহমেদ জানান, ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙন রোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ওই এলাকায় ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শেরপুর ও জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ বলেন, ‘ব্রক্ষপুত্র নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নকলার নারায়ণখোলাতেও নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমার ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। ভাঙনরোধে অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’