সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর হিসাবে প্রতি কিলোমিটার বাস ভাড়া হবে আড়াই টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। এই হিসাবে চার কিলোমিটার যাওয়া যাবে এই সর্বনিম্ন ভাড়ায়।
কিন্তু রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটারে স্বাধীন পরিবহন ভাড়া আদায় করছে ১৫ টাকা, যা এতদিন আদায় করা হতো ১০ টাকাই।
গত শুক্রবার সরকার ডিজেলের ভাড়া ৩৪ টাকা বাড়ানোর পরদিন বাস ভাড়া বাড়ানোর যে ঘোষণা আসে, তাতে রাজধানীতে কিলোমিটারপ্রতি বাড়ানো হয় ৩৫ পয়সা।
এই ভাড়া বাড়ানোর প্রজ্ঞাপনে পরে জানিয়ে দেয়া হয়, সর্বনিম্ন ভাড়া বাড়বে না। এর আগে নভেম্বরে সবশেষ তেলের দাম বাড়ানোর পর যে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়, সে সময় জানিয়ে দেয়া হয় সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা।
সে সময় রাজধানীতে বাস ভাড়া ঠিক করা হয় কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে। কিন্তু স্বাধীন পরিবহন সরকারের এই নিয়ম না মেনে স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করতে থাকে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা আরও বেড়েছে এবার।
কিলোমিটারের বদলে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত আলাদা ভাড়া রাখার হিসাব করতে বসানো হয় ওয়েবিল। পুরো পথের জন্য কিলোমিটার হিসেবে একটি ভাড়া ঠিক করার পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত পথের ভাড়া ঠিক করা হয় ওয়েবিল থেকে অন্য ওয়েবিল পর্যন্ত।
এক ওয়েবিল থেকে আরেকটি পার হয়ে গেলেই ভাড়া নেয়া হতে থাকে ১০ টাকা করে। কিন্তু এই ওয়েবিলগুলো ৪ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার দূর দূর বসানো হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বসানো হয় দুই কিলোমিটার অন্তর অন্তর।
ফলে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া কার্যত পড়ে ৫ টাকা, যা ছিল সরকার নির্ধারিত হারের ২ দশমিক ৩২ গুণ।
এবার সেই ওয়েবিল থেকে আরেক ওয়েবিল পর্যন্ত ১৫ টাকা করে দাবি করতে থাকায় যাত্রীরা এবারও ঠকতে শুরু করেছে।
যেমন মোহাম্মদপুর থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা হতে পারত। কিন্তু ফার্মগেট পর্যন্ত ১৫ টাকা আদায় করার পর কিলোমিটারপ্রতি ভাড়ার হার দাঁড়ায় ৪ টাকা ৫৪ পয়সা।
অথচ একই বাসে কোনো দূরত্বের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ছয় টাকাও দেখা গেছে।
আগে থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা স্বাধীন পরিবহন ভাড়া বাড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। অথচ সরকার ভাড়া বাড়িয়েছে ১৬ শতাংশ। আর বাড়ানোর পর যে হারে ভাড়া ঠিক হয়েছে, আগে থেকেই তার চেয়ে বেশি আদায় হচ্ছিল।
স্বাধীন পরিবহনের যাত্রীদের একজন তানজিনা খানম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থেকে আগে মালিবাগ রেল গেটে ভাড়া নিত ২০ টাকা। আজকে ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা। এরা ভাড়ার কোনো সামঞ্জস্য রাখছে না। যা খুশি নিচ্ছে।’
ভাড়া বাড়ার আগে এই রুটে আদায় করা হতো ২০ টাকা।
এই পথের দূরত্ব ৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার। আগের হারে ভাড়া হয় ১৪ টাকা ৪০ পয়সা। বর্তমান হারে তা আসে ১৬ টাকা ৭৫ পয়সা। অর্থাৎ বাড়তি আদায় করা হচ্ছে ১৩ টাকা ২৫ পয়সা।
আড়াই টাকা কিলোমিটারের বদলে আদায় করা হচ্ছে ৪ টাকা ৪৭ পয়সা হারে।
অবৈধ ওয়েবিলেই ভাড়া আদায় করা হয় স্বাধীন পরিবহনে। কখনও ব্যবস্থা নেয়নি বিআরটিএবেশি কেন নিচ্ছে এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি গাড়ির চালকের সহকারী মো. সুজন। তিনি বলেন, ‘বাংলামোটর চেকার আছে। তার কাছে জিজ্ঞাসা করেন।’
আরেক যাত্রী সুমন মিয়া বলেন, ‘আসাদ গেট থেকে দক্ষিণ বনশ্রী পর্যন্ত আগে স্টুডেন্ট ভাড়া দিতাম ২০ টাকা। মূল ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। গতকাল থেকে একই দূরত্বে আমাদের থেকে ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা। ফুল ভাড়া ৬০ টাকা।’
এই পথের দূরত্ব আসে ১০ কিলোমিটারের মতো। আগের হারে ভাড়া আসে ২১ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমান হারে আসে ২৫ টাকা।
অর্থাৎ আড়াই টাকার বদলে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৬ টাকা হারে।
ভাড়া বেশি কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে স্বাধীন পরিবহনের চালক মো. মাসুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এইটা কোম্পানির লোককে জিজ্ঞাসা করেন। আমরা জানি না। তেলের দাম বাড়ার পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে আমাদের যেভাবে বলে দিছে সেইভাবেই ভাড়া কাটতেছি।’
ওয়েবিলের নামে বেশি টাকা নিচ্ছেন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটাও কোম্পানির লোক জানে।’
বেশি ভাড়া নেয়ার বিষয়ে ইস্কাটনে ওয়েবিলের চেকার নাজমুল হাসান বলেন, ‘এটা কোম্পানিরে জিজ্ঞাসা করেন কেন বেশি নিচ্ছে।’
একই প্রশ্নে স্বাধীন পরিবহনের ইনচার্জ রিয়াজ রহমান বেশি ভাড়া নেয়ার কথা বেমালুম অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বেশি ভাড়া নেই না।’
বেশি ভাড়ার আদায়ের প্রমাণ দেখালে তিনি আবার বলেন, ‘আমরা বেশি ভাড়া নেইনি।’
বিআরটিএ তো ওয়েবিলকে অবৈধ বলেছে। এই অবৈধ পদ্ধতিতে কেন ভাড়া কাটছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পাঁচ লিটারের বোতল তেল থেকে কেউ যদি এক লিটার তেল চায় দোকানদার কি দেবে? দেবে না। তাছাড়া দিন শেষে ভাড়ার হিসাব রাখার জন্যও তো ওয়েবিলের দরকার আছে।’
বিআরটিএ চেয়ারম্যান কী বলছেন
বাস ভাড়া পুনর্নির্ধারণের রাতে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে যখন সিদ্ধান্ত জানান, সেদিনই তিনি বাস ভাড়ায় নৈরাজ্য, বিশেষ করে ওয়েবিলের মাধ্যমে ভাড়া কাটার বিষয়ে প্রশ্নের মুখে তোলেন।
আপনাদের ঘোষিত ভাড়া কখনও কার্যকর হয় না। ওয়েবিলের নামে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি হারে আদায় করা হয়। তাহলে কেন এভাবে ভাড়া নির্ধারণ করেন- এমন প্রশ্নে নুর মোহাম্মদ মজুমদার সেদিন বলেন, ‘গতবার ভাড়া নির্ধারণ করার পর মালিক সমিতি, শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্য, বিআরটিএ, পুলিশ যৌথ টিম কাজ করেছে, যা কয়েক মাস অব্যাহত ছিল। যারা অতিরিক্ত ভাড়া নিয়েছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি।’
ওয়েবিলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওয়েবিল যেটা বলেছেন, সেটা অবৈধ জিনিস। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট যদি এই ধরনের অভিযোগ পায় বা দেখতে পায়, তাহলে আইনের আওতায় আনা হবে।’
গত নভেম্বরে বাস ভাড়া বাড়ানোর পরও বিআরটিএ চেয়ারম্যান একই ধরনের কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, ওয়েবিলে চালানো হলে বাসের রুট পারমিট বাতিল হবে, জব্দ হবে।
কতগুলো বাস জব্দ করা হয়েছে- সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে বলতে পারব না।’
বাস ভাড়া বাড়ার পর রাজধানীর চিত্র তুলে ধরে বিআরটিএর বক্তব্য জানতে গত দুই দিন ধরে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা।
কমপক্ষে ২০ বার ফোনে চেষ্টা করার পর একবার কল ধরলেও তার কথা বোঝা যাচ্ছিল না। পরে তিনি এসএমএস করতে বলেন।
বিআরটিএ প্রধানের কাছে প্রশ্ন ছিল: ‘ভাড়া নির্ধারণ করেছেন আড়াই টাকা কিলোমিটার হিসেবে। কিন্তু অনেকে ভাড়া নিচ্ছে ৬ টাকা পর্যন্ত। ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে আগেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নাই। একবারও করতে পারছেন না। অবৈধ ওয়েবিল এখনো চালু আছে। যাত্রীরা ঠকছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আপনাদের এই ব্যর্থতার কী জবাব দেবেন?
তবে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির সমালোচনা
স্বাধীন পরিবহনের যে চিত্র, সেটি কার্যত প্রতিটি বাসেরই। যাত্রীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ভাড়া বাড়িয়েছে কিলোমিটার হিসাবে। রাজধানীর বাসে ওয়েবিলে আগে যে বাড়তি ভাড়া নিত, তার সঙ্গে আবার নতুন করে পাঁচ থেকে ১০ টাকা যোগ করেছে। আমাদের অভিযোগটাও সেই জায়গায়।’
বিআরটিএর জরিমানায় কাজ হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটা পরিবহনের বাস যদি ৮০টি হয়, একটি বাসকে জরিমানা করল, তাহলে বাকি ৭৯টি বাস তো নৈরাজ্য চালাচ্ছেই। অতীতে যে রকম লোক দেখানো অভিযান চালানো হয়েছে, ওই ধরনের অভিযান দিয়ে এই অভিযোগ নিষ্পত্তি করা যাবে না। কোম্পানির প্রধানকে ধরে আনতে হবে। ধরে এনে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাস স্টপেজগুলোতে ডিজিটাল ভাড়ার তালিকা টানাতে হবে। বিআরটিএ যেটা ভাড়ার তালিকা দেয়, এটা তো সাধারণ যাত্রীরা বোঝে না। এই ধরনের গোজামিল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই গোঁজামিল অতিরিক্ত ভাড়াকে উৎসাহিত করে।’
নৈরাজ্য ঠেকাতে না পারলে বাড়তি ভাড়া স্থায়ী হয়ে যাবে উল্লেখ করে মোজাম্মেল বলেন, ‘তিন-চার দিন বেশি ভাড়া নিলে এটা নিয়মিত ভাড়ায় তৈরি হবে। সেই সুযোগটি করে দেয়া হচ্ছে।’