কলা চাষকে ঘিরে নাটোরের বনপাড়ায় গড়ে উঠেছে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বড় একটি হাট। এ ছাড়া গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরেও বড়সড় আরেকটি কলার হাট বসে। যেখানে প্রতি হাটে কোটি টাকার বেশি কলা বেচাকেনা হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই কলা চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়াসহ সাতটি উপজেলায় পুকুর পাড়, বাড়ির আঙিনাসহ ছোট-বড় পতিত জমিতে কলা উৎপাদন করছেন চাষিরা। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে কলার চাষ।
বর্তমানে প্রতি কাঁদি কলা বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। অল্প সময়ে প্রতি বিঘা জমিতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয়ও হচ্ছে প্রান্তিক চাষিদের। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ হওয়ায় কম খরচে নিরাপদ খাদ্য জোগানের পাশাপাশি কৃষক ও ব্যবসায়ীদের অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে কলা।
কলার উৎপাদনকে কেন্দ্র করে বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বড় একটি হাট। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সকাল থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনায় মুখরিত হয় হাটটি।
এ ছাড়া গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরেও বড়সড় একটি হাট বসে। সেখানে শুক্র ও শনিবার বাদে সপ্তাহে ৫ দিনই কলা বেচাকেনা হয় । হাট দুটিতে অনুপম, সাগর, আনাজি, চাপা, জীন মোট এই ৫ ধরনের কলা আসে আশপাশের জেলা থেকেও। চাহিদা বাড়ায় একেকটি হাট থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ ট্রাক কলা চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
বড়াইগ্রামের বাসিন্দা শাহ আলম মাস্টার জানান, জৈব সার ব্যবহার করে এই অঞ্চলে কলার ফলন ভালো হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভ বেশি এবং খরচ কম হওয়ায় এই এলাকার কৃষকরা এখন কলা চাষের দিকে ঝুঁকছে। কলা চাষে সফলতা দেখে এলাকার অন্য চাষিরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
গুরুদাসপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের কলা চাষি আমিনুল ইসলাম লিটন বলেন, ‘মাছের পাশাপাশি পুকুরপাড়ে কলা চাষ করেছি। মাছে লাভ কম হলেও কলায় প্রচুর লাভ হয়েছে। একবার কলাগাছ লাগালে ৩ থেকে ৪ মৌসুম বিক্রি করা যায়। এ বছর ৩০ বিঘার পুকুরপাড়ে কলার চাষ করেছিলাম। খরচ বাদে ৪ লাখ টাকা লাভ হয়েছে।’
বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের প্রভাষক কৃষিবিদ জহুরুল হক সরকার বলেন, ‘আমি এক একর জমিতে কলা চাষ করেছি। বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ করে প্রায় দেড় লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছি। এই এলাকার মাটি অত্যন্ত উর্বর। তাই ফসলের পাশাপাশি সব ধরনের ফল- বাঙ্গি, তরমুজ, লিচু, আম ও কলা ভালো হয়। এ কারণে এই এলাকার কৃষকরা ফসলের সঙ্গে ফল চাষেও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’
হাট ইজারাদার নজরুল ইসলাম জানান, গুরুদাসপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন ছাড়াও নাটোরের সিংড়া ও বড়াইগ্রাম থেকেও প্রচুর পরিমাণে কলা আসে নাজিরপুর হাটে। প্রতি কাঁদি কলা আকারভেদে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বনপাড়ায়ও সপ্তাহে দুই দিন কলার জমজমাট হাট বসে।
টাঙ্গাইল থেকে কলা কিনতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী মামুন মিয়া বলেন, ‘কলার চাহিদা প্রচুর। সম্প্রতি কলার দামও বেড়েছে। আগে প্রতি কাঁদি কলা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ছিল। এখন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। নাটোরে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় প্রতি হাট থেকে এক ট্রাক কলা কিনে নিয়ে যাই।’
স্থানীয় শ্রমিক নেতা মো. মোস্তফা জানান, এই কলা হাটের জন্য শ্রমিক, পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, মুদি দোকানিসহ অনেকেরই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণে দূর-দূরান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীরাও সহজেই যাতায়াত করতে পারেন।
বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা জানান, নাটোরে এক হাজার ৮৯ হেক্টর জমিতে প্রাকৃতিক উপায়ে কলা চাষ হয়। তার মধ্যে চলতি বছর বড়াইগ্রামে ৩০৯ হেক্টর জমিতে কলার উৎপাদন হয়েছে। এই উপজেলার বনপাড়ায় বড় একটি কলার হাট গড়ে উঠেছে। নিরাপদ কলা চাষে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হয়।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মতিউর রহমান বলেন, ‘গত বছর উপজেলায় ২৫০ হেক্টর জমিতে কলার চাষ করা হয়েছিল। এ বছর আরও ৫০ হেক্টর কলা চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কলা চাষিদের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। বছরজুড়েই কলার চাহিদা থাকে। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই চাষ বৃদ্ধি করা গেলে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে কলাও অন্যতম ভূমিকা রাখবে বলে মনে আমি মনে করি।’