হাতিরঝিল ধরে হাঁটছিলেন আল ফারুক। গাছের ছায়াঘেরা ফুটপাত পেরিয়ে যখন এফডিসিসংলগ্ন সেতুতে ওঠেন, তখন তীব্র রোদে গরমে পুড়তে হয় তাকে।
বর্ষার এই সময়ে চৈত্রের কাঠফাটা রোদ যেন- নিউজবাংলাকে বলছিলেন ফারুক। বলেন, ‘সামান্য দুই থেকে তিন শ মিটার পথ হাঁটতে গিয়ে আমি ঘেমে একাকার। মাথা ভিজে পুরো চুপচুপে হয়ে গেছে।’মিরপুর থেকে বাইকে করে বাড্ডায় আসা নাহিয়ান আরেফিন বলেন, ‘গরমের কথা কী আর বলব? রোদে এতটা গরম হয়েছিল যে সিটে বসার সাহস পাচ্ছিলাম না। সম্ভব হলে দাঁড়িয়ে বাইক চালাতাম। এই সময়ে জীবনেও এমন গরম দেখি নাই।’
তিনি বলেন, ‘ফ্যানের বাতাসটাও গরম লাগে বাসায়। বাইরে বের হলে মনে হয় পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে বাংলাদেশকে রেখে দিছে।’
এবারের বর্ষা শীতলতা আনেনি। বরং গ্রীষ্মের মতো উত্তাপ ছড়িয়ে মানুষের ঘাম ঝরাচ্ছে। ঢাকা মহানগর যেন উত্তপ্ত কড়াই।
তাপমাত্রা মাপার পারদে রোববার দুপুরে বাড্ডা এলাকায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তর দেখাচ্ছিল সে সময় ঢাকার গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি।
তবে পারদে যতটা তাপ দেখায়, মানুষের মধ্যে গরমের অনুভূতি থাকতে পারে তার চেয়ে বেশি।
আবহাওয়াবিষয়ক ওয়েবসাইট অ্যাকুওয়েদারের হিসাবে বাড্ডায় তখন তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছিল ৪১ ডিগ্রি। এটাকে বলে রিয়েল ফিল, মানে আসলে কত ডিগ্রির সমান তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে।
একই সময়ে মরুভূমির দেশ সৌদি আরবের অন্যতম বড় ও ব্যস্ত শহর জেদ্দার তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখানেও রিয়েল ফিল ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সেখানকার পূর্বাভাস অনুযায়ী সর্বোচ্চ মাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। তখন রিয়েল ফিল থাকবে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অ্যাকুওয়েদারের পূর্বাভাস অনুযায়ী দিনের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। তখন অনুভূত হবে ৪২ ডিগ্রির মতো।
সাধারণত কোনো এলাকার আর্দ্রতা, মেঘাচ্ছন্ন অবস্থা এবং বৃষ্টি ও বাতাসের সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করে অনুভূত তাপমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
৪২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টি
বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই, আগের কয়েক প্রজন্ম এমন বৃষ্টিহীন বর্ষা দেখেনি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য-উপাত্ত বলছে, এবার জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত গত ৪২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। স্বাভাবিকভাবে গরমটাও বেশি। তবে আগামী দুই দিনের মধ্যে বৃষ্টির মৌসুমি বায়ু সৃষ্টি হতে পারে।
বৃষ্টিহীন বর্ষায় এমন তীব্র গরমকে অস্বাভাবিক আবহাওয়া বলছেন খোদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবদুল মান্নান। বলেছেন, ‘এবারের আবহাওয়াটা তো একটু অন্য রকম।’
তিনি জানান, জুলাই মাসে দেশে গড়ে ৪৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও এবার বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে ২১১ মিলিমিটার, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে যা ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ কম।
নিউজবাংলাকে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, ‘এখন আবহাওয়া অনেকটা অসহনীয়। রোববার বিকেল পর্যন্ত ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের কোনো কোনো স্থানে ৩৬ ডিগ্রির ওপরে আছে। এমন আবহাওয়া বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই হচ্ছে।
‘বৃষ্টি কেন হচ্ছে না’- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতেও বর্ষা কখনও বৃষ্টিহীন গেছে। তবে এবার ব্যতিক্রম। এবার দীর্ঘ সময় ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে না। আর বৃষ্টি হলেও তার পরিমাণ খুবই অল্প। যার কারণে গরম আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একটি উচ্চ তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়েছে।’
এমন হওয়ার কারণ কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে মেঘমালা সেটা এবার নেই। বঙ্গোপসাগরে এই বর্ষার উৎপত্তি। সেখান থেকে এবার পর্যাপ্ত শক্তি না পাওয়ার কারণেই এবার বর্ষা দুর্বল। মানে এবার বর্ষাকাল তেমন বৃষ্টিপাত ঘটাতে সক্ষম হয়নি।’
এ থেকে উত্তরণের কি কোনো আভাস নেই?
মান্নান বলেন, ‘আমরা আশা করছি, দুই দিন পরে বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। তখন বৃষ্টিপাত একটু বাড়বে।’
এই সময়ে এত গরম স্বাভাবিক নয়
আরেক আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানান, বর্তমানে যে তাপমাত্রা, সেটি বছরের এই সময়ের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জুলাই মাসে দিনে বাংলাদেশে অন্য মাসগুলোর চেয়ে গড়ে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি বেশি ছিল। গত বছরগুলোতে এর চেয়ে তাপমাত্রা কম ছিল। এটি রেকর্ড।’
এবার আবহাওয়া এমন রুক্ষভাব দেখাচ্ছে কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে তাপমাত্রা বেশি। এটা শুধু বাংলাদেশ না, অনেক দেশেই বেশি। তবে এটা মরু আবহাওয়ার মতো নয়। মরুভূমির প্রেক্ষাপট আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।’