ঘরের ভেতর কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে বাদাম খাচ্ছেন গঙ্গাচড়ার পশ্চিম ইচলীর বাসিন্দা আব্দুস সোবহান। খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত না থাকায় বাদাম, চিড়ামুড়ি খেয়ে পরিবার নিয়ে ছয় দিন ধরে এভাবেই দিন পার করতে হচ্ছে তাকে। দিনে বাড়িতে থাকলেও সাপ ও পোকামাকড়ের ভয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে বাঁধে।
তিস্তার বাড়ন্ত পানিতে এবার প্লাবিত হয়েছে গঙ্গাচড়ার পূর্ব ও পশ্চিম ইচলী, কেল্লার পাড়, বাগেরহাটসহ আশেপাশের সহস্রাধিক বাড়ি।
স্থানীয়রা বলছেন, এ বছর ছয়বার প্লাবিত হয়েছে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল। আসছে ভাদ্রের বন্যায় আরেক দফায় প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বৃষ্টি না থাকলেও উজানের বাড়ন্ত পানিতে বাড়ি ঘরে পানি ঢোকায় ক্ষুব্ধ নদী পাড়ের মানুষজন। বছর বছর এই অবস্থা বাড়ছেই।
নদীপাড়ের মানুষজন বলছেন, এখন আর নদীর গভীরতা নেই। নদীতে বালু আর বালু। একটু পানিতেই নদী উপছে বাড়ি ঘরে পানি উঠছে।
কেন এই অবস্থা
নদী গবেষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারতের সিকিম থেকে ১৭৮৭ সালে তিস্তা নদীর গতিপথ বদল হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে লালমিনরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা ছুঁয়ে মিলিত হয় কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদে। ৩১৫ কিলোমিটারের এই নদীর ১১৫ কিমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। ২০১৪ সালে তিস্তার ভারতীয় অংশের গজলডোবায় বাঁধ দেয় তারা।
‘কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও উজানি ঢলে আসা বালু আর পলি পড়ে ধীরে ধীরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে । নদীর গতিপথ বদল হয়ে সীমানা বাড়লেও গভীরতা কমছে।’
তিনি বলেন, ‘২৩৫ বছরের এই নদীর কোন পরিচর্যা হয়নি। বরং নদীর ক্ষতি হয় এমন বহু প্রকল্প করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নদীর পরিচর্যা করা না গেলে আশির্বাদি তিস্তা অভিশাপে পরিণত হবে। নদীর অস্তিত্ব বিলিন হবে। মানুষের আর্ত-সামাজিকতা নষ্ট হয়ে যাবে।’
তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকায় মানুষের জীবন যাত্রা স্থবির হয়ে যায়। ধুধু মরুতে পরিণত হয়। জীব-বৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নদীর পরিচর্যা ও খনন করলে, পাড়ের মানুষজন এত কষ্টে পড়ত না।’
৬ বারের পানিতে কেমন আছেন তিস্তা পাড়ের মানুষজন
গত ৬ আগষ্ট শনিবার গংগাচড়ার বিভিন্ন চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে পানি ওঠায় লোকজন আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে, বাঁধে ও আত্মীয়ের বাড়িতে। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ আমনের খেত। পানিবন্দী পরিবারগুলো গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে উঁচু নিরাপদ স্থানে। শুক্রবার সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করেছে, তবে দুর্ভোগ আছেই।
বাঁধের পাড় এলাকার বৃদ্ধা সাহের বানু বলেন, ‘মোর ব্যাটা চট্টগ্রামোত থাকে, বাড়িত আসছে ব্যাটার বউওক নিয়ে পানিত ডুববের নাগছি। খাওয়া-দাওয়া ঘুম সউগ হারাম হয়া গেইছে।’
চর পশ্চিম ইচলি গ্রামের রুপালী বেগম বলেন, ‘হঠাৎ পানি আসার কারণে বাড়ি থাকি কিছু বাহির করিবার পাই নাই। ধান, চাল ঘরোত যা আচিল সউগ ভিজি গেইছে।’
একই ইউনিয়নের মোকতার হোসেন বলেন, ‘গত মঙ্গলবার থাকি রাস্তার ধারে পলিথিন টাংগি আছি। এবার ৬ বার পানি আসিল, ছয় বার বাড়ি ছাড়ি রাস্তাত আসি। সরকার তো চায় হামরা নদীর পারের মানুষ না খেয়া মরি..। সরকার নদীও বান্ধি দিবার নেয়। হামার গুলার কোনো সামাধানও দিবার নেয়।’
বাঘেরহাট এলাকার বাসিন্দা সাদেকুল বলেন, ‘পানি খাওয়া যে টিউবল, সেটিও পানির নিচত তলে আছে, পানি খাওয়ার বুদ্ধিও নাই। সকাল থাকি বাসিমুখে আছি, একনা দানা মুখে যায় নাই।’
নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া ও নদীশাসন না করার ফলে অল্প পানিতে আক্রান্ত হচ্ছে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর ও ফসলি জমি। প্রতি বছর শত শত বিঘার জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান লক্ষীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি।
তিনি বলেন, ‘এর আগে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপরে পানি উঠলেও আমার এই ইউনিয়নের পশ্চিম বাগের হাট আশ্রয়নে পানি ওঠেনি। কিন্তু এবার ১৭ সেন্টিমিটার বেশি পানিতেই ওই এলাকায় পানি উঠেছে।
‘আগে টানা তিন থেকে পাঁচদিন পানি আসার পর বাড়ি ঘরে উঠত। তখন নদীর অনেক গভীরতা ছিল। এখন গভীরতা না থাকায় সামান্যতেই বাড়ি-ঘরে পানি উঠছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উজানের বাড়ন্ত পানি এবার বাড়ি-ঘরে উঠে পড়েছে। এই পানির কারণে বেশ কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপরে ওঠে গেছে। কিছু কিছু এলাকায় ভাঙ্গনের খবর এসেছে, আমরা সেগুলোর ভাঙ্গন ঠেকাতে কাজ করছি।’
তিস্তা ভরাটে কী প্রভাব পড়েছে
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী জানান, ১৯৮৩ সালে জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ নদীপ্রবাহের জন্য নদীতেই সংরক্ষিত রাখা হবে।
কিন্তু কখন থেকে এবং কোথা থেকে এই পানি ভাগাভাগি করা হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না ওই বৈঠকে।
এরপর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশ ভাগ করে বাকি ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয়। ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। ২০১৪ সাল গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারত তিস্তার পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়।
তিনি বলেন, ‘উজান থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করায়, পানির অভাবে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরে যায়, মরে গেছে। প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে উঠেছে। বর্ষাকালে পানি ছেড়ে দেয়ায় প্রবল পানির চাপে মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে প্রবাহিত হতে থাকে।
‘তখন কূলকিনারাবিহীন সমুদ্র হয়ে যায় তিস্তা। তখন তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোনো কোনো জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশি হয়ে পড়ে। পানির চাপ ও বন্যায় প্রতি বছর এই অঞ্চলের শত শত মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে ভূমিহীন ও ছিন্নমূল হয়ে পড়ছে।’
অধ্যক্ষ হক্কানী বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলে তেমন শিল্প-কারখানা নেই। কৃষিব্যবস্থা পুরোটাই পানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে বন্যা-খরা এখানে মানুষের দুর্ভোগের কারণ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পূরণ করা, নাব্য রক্ষা, পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা না করলে দ্রুত এক অশনিসংকেত দেখবে তিস্তা বেষ্টিত রংপুর অঞ্চলের মানুষ।’
সমাধান কী
তিস্তা সুরক্ষা কমিটির আহবায়ক নদী গবেষক অধ্যাপক মঞ্জুর আরিফ বলেন, ‘তিস্তা নদী কেমন ছিল কেমন হয়েছে। নদী পাড়ের মানুষজন বলছেন আমাদের এত প্রশস্ত নদীর প্রয়োজন নেই। মূল তিস্তা এত প্রশস্ত ছিল না। তিস্তা ভরাট হতে হতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী নাব্য থাকলে প্রশস্ত হত না।
তিস্তাকে নাব্য রাখতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নদী খনন করে নদীর প্রাকৃতিক গঠন ও ধরন বজায় রাখতে হবে।
‘যখন শুকায়ে যাচ্ছে অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবেশী দেশ পানি আটকিয়ে রাখছে। প্রতিদিন, প্রতি মাস বা প্রতি বছর যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিন্ন নদীর অভিন্ন অধিকার রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আলোচনার মাধ্যমে হোক, সমঝোতার মাধ্যমে হোক বা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হোক উদ্যোগ নিতে হবে।
‘যদি আন্তনদীর ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া যায় তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে এবং সে লক্ষ্যে জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ আইন (১৯৯৭) অনুস্বাক্ষর করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাতে হবে। নদী ব্যবস্থাপনায় সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে নদী নিয়ে বাংলাদেশের যে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা আছে তা ভেস্তে যাবে।’