বয়স সদ্যই ১২ পেরিয়েছে। এ বয়সেই সংসারের বোঝা টানতে হচ্ছে মা-হারা মুনিরাকে। দেড় বছর ধরে বাড়িতেই পড়ে আছেন তার অসুস্থ বাবা মনির হোসেন।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার চরবাসরী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, হাফসা আক্তার মুনিরার জীবনসংগ্রাম। যে বয়সে বিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা আর পড়াশোনায় মেতে থাকার কথা, সেই বয়সেই শীর্ণ হাতে বৈঠা ধরে নদী পার হতে চাওয়া মানুষের অপেক্ষায় বসে আছে সে।
নৌকায় যাত্রী পারাপার করে যে টাকা আয় হয়, সেই টাকায় চলে বাবাকে নিয়ে তার সংসার। তার বাবা মনির হোসেনও ছিলেন খেয়া পারাপারের মাঝি। দেড় বছর আগে তার চোখে সমস্যা দেখা দিলে বন্ধ হয়ে যায় সংসারের রোজগার।
অন্য কোনো উপায় না থাকায় বাবার নৌকাটি দিয়েই সংসারের চাকা ঘোরাতে শুরু করে মুনিরা। শুধু তা-ই নয়, বাবার পেশায় ব্যস্ত এ মেয়েটি পড়াশোনায়ও ভালো। এত কষ্টের মাঝেও স্কুলের পড়া চালিয়ে যাচ্ছে সে।
রোজগার, পড়াশোনা, ঘরদোর সামলানো, রান্নাবান্নাসহ যাবতীয় কাজ একাই সামলানো মুনিরা গ্রামের সবার কাছেই এখন উদাহরণ। তার পরিশ্রমের কথা যারা জানেন, নদী পার হয়ে তাদের অনেকেই মুনিরাকে ৫ টাকার জায়গায় ১০ টাকা দিয়েও সহযোগিতা করছেন।
গ্রামবাসী মনে করেন, একটু সহযোগিতা পেলে মুনিরা একদিন অনেক বড় হবে। সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়বে।
মুনিরার বিষয়ে চরবাসরী গ্রামের ইদ্রিস মোল্লা বলেন, ‘এ মেয়েটা ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। ঘরে প্রতিবন্ধী বাবাকে রেখে তীব্র স্রোতের মধ্যেই খেয়া পারাপার করছে সে।’
মুনিরার নৌকায় নিয়মিত নদী পার হওয়া হাসিনা বেগম বলেন, ‘মুনিরা অনেক শান্ত মেয়ে। সব সময় চুপচাপ থাকে। আমরা ওর নৌকায় উঠলে কেউ ৫ টাকা আবার কেউ ভালোবেসে ১০ টাকাও দিই। তা দিয়ে চলে ওর সংসার।’
সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মনিরা বলে, ‘কষ্ট করে হলেও আমি পড়াশোনা শেষ করতে চাই। তাই সব সময় বই-খাতা হাতের কাছেই রাখি। আমার স্বপ্ন, একদিন বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াব। আপনাদের সবার দোয়া চাই।’
কাউখালী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আব্দুল লতিফ খসরু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বয়সে সংসারের উপার্জন থেকে ঘরের সব কাজ সামলাতে গিয়ে পড়ালেখার বারোটা বাজার কথা। কিন্তু তা ঘটেনি! মুনিরা ইতোমধ্যেই প্রাইমারি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা রেখেছে। তাও যেনতেনভাবে নয়- শুনেছি পড়াশোনায়ও ভালো সে।’
সংসারের হাল ধরায় এক বছর ধরে স্কুলে অনিয়মিত মুনিরা
এদিকে মুনিরার স্কুল কাউখালী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাইনুল ইসলাম জানান, আগে নিয়মিত স্কুলে গেলেও গত বছর ধরে মুনিরা অনিয়মিত। এই অনিয়মিত থাকার পেছনের কারণটিও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানে। মেধাবী এই শিক্ষার্থী হারিয়ে যাক- এমনটি তারা চায় না।
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘ওর পড়ালেখায় অনেক মনোযোগ। মানুষের সহযোগিতাই পারে তাকে ক্লাসরুমে ফেরাতে।’
মুনিরার বিষয়টি পিরোজপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মনিরা পারভীনকে জানালে তিনি বলেন, ‘জেলায় অর্থের অভাবে কোনো শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হবে না। অসহায় মুনিরার পাশে থাকবে জেলা প্রশাসন।’
তিনি জানান, মুনিরার খোঁজখবর নিয়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে ইতোমধ্যে কাউখালীর ইউএনওকে বলা হয়েছে।