কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের বড় আজলদী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মান্নান। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্ম ১৯১৫ সালের ৫ জুন। সে হিসাবে তার বয়স ১০৭ বছর। তবে তার দাবি বয়সটা ১১৫ বছরেরও বেশি।
শত বছর পার করা এই মানুষটি এখনও চলাফেরা করেন নিজে নিজে। কারও সহযোগিতার প্রয়োজন বোধ করেন না তিনি।
গ্রামের কাদামাটিতে বেড়ে ওঠা শতবর্ষী আবদুল মান্নান অংশগ্রহণ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। আর এ জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভাতা পেয়ে আসছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্থানীয় এক মৌলভীর মাধ্যমে তিনি চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বরাবর। আর সেই চিঠির জবাবও দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। আর এই চিঠির জবারের পর থেকে চালু হয় আবদুল মান্নানের ভাতা।
মঙ্গলবার দুপুরে পাকুন্দিয়ার বড় আজলদী গ্রামে আবদুল মান্নানের বাড়ির সামনে যেতেই দেখা যায় বেশ কিছু মানুষের জটলা। বাড়ির উঠানে মাথায় কালো টুপি আর গায়ে খাকি কালারের জামা আর পায়ে কালো সুজ পরিহিত একজন বৃদ্ধা বসে আছেন।
তিনিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ সৈনিক আবদুল মান্নান। আর বাড়ির উঠানে জটলার সৃষ্টি তাকে ঘিরেই।
সেখানে গিয়ে কথা হয় আবদুল মান্নানের সঙ্গে। শত বছর পার করা এই সৈনিক এখনও ভোলেননি তখনকার স্মৃতি। কথা বলেন ইংরেজিতে। এই ভাষা তিনি শিখেছেন ইংরেজদের কাছ থেকে।
সাংবাদিক পরিচয় দিতেই হাত ধরে টেনে নিয়ে যান নিজের ঘরে। শুরু করেন স্মৃতিচারণা। একপর্যায়ে ঘরে থাকা পুরোনো ট্রাংক থেকে বের করে আনেন ওই সময়কার কাগজপত্র, যুদ্ধ শেষে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চিঠির জবাব। বের করে আনেন যুদ্ধকালীনের পোশাক।
পোশাকে এখনও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন র্যাংক মেডেল ঝুলে রয়েছে। সেই যুদ্ধের এমন তিনটি পোশাক ও বিভিন্ন কাগজপত্র এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ঘরের ট্রাংকে থাকা এসব কাগজপত্র ও পোশাকে কাউকে হাত দিতে দেননি।
কীভাবে যুদ্ধে গেলেন?
মান্নান বলেন, ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তার বাবা আবদুর রহমান স্থানীয় বাজারে গিয়ে শোনেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীতে নেয়ার জন্য ঢোল পিটিয়ে লোক সংগ্রহ করছে। যারা আগ্রহী, তারা যেন কিশোরগঞ্জ সদরের ডাকবাংলোতে গিয়ে অংশগ্রহণ করেন।
এ ঘোষণা শুনে মান্নানের বাবা তাকে সেখানে যেতে বলেন। মান্নান গিয়ে দেখেন দেরি হয়ে যাওয়ায় লাইন অনেক লম্বা হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন পেছনে। এক পর্যায়ে তিনি শুনতে পান, ওজনে ও লম্বায় কম হলে তাদেরকে সৈনিক হিসেবে নেয়া হবে না। তিনি ওজন, সুস্বাস্থ্য এবং উচ্চতার মাপে প্রাথমিক বাছাইতে টিকে যান।
তিনি বলেন, এরপর লাইন থেকে সৈনিক বাছাই করতে আসেন এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা। তিনি এসেই সবার বুকে জোরে থাপ্পড় মারতে থাকেন। থাপ্পড় খেয়ে অনেকে মাটিতে পড়ে গেলেও তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
পরে প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তান ও চীনের সীমান্ত এলাকা হাসনাবাদে নেয়া হয় তাদের।
প্রশিক্ষণের সময় জ্বরে আক্রান্ত হন মান্নান। সেখানে দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা তার বাবার কাছে চিঠি পাঠান। এতে সেই কর্মকর্তা লেখেন, ‘আপনার ছেলে ভীষণ অসুস্থ, যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। এখন আমাদের করণীয় কী?’
জবাবে মান্নানের বাবা লেখেন, ‘তাকে জীবিত পাই বা না পাই, ছেলের মরদেহটি পেলেই হবে। তাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছি সৈনিক হিসেবে। জীবন-মরণের প্রশ্নই আসে না।’
পরে জ্বর সেরে যায় আর এক মাসের প্রশিক্ষণ শেষে মান্নানের ব্যাটালিয়ন ক্যাপ্টেন ড. গলিব আদুল তাকে ল্যান্স নায়েকের দায়িত্ব দেন। তার অধীনে ছিল ১১ জন সৈনিক।
মান্নান জানান, প্রশিক্ষণ শেষে সেখান থেকে চার হাজার সৈনিক সমুদ্রপথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। বড় একটি জাহাজে করে ছয় মাসের খাবার নিয়ে কলম্বোর দিকে রওনা দেন তারা। সেই জাহাজে অস্ত্র, গোলাবারুদসহ চারটা কামান বিভিন্ন দিকে তাক করা ছিল।
জাহাজে শুধু ভারত উপমহাদেশীয় সৈনিকরা ছিল। জাহাজটি টানা এক মাস আটলান্টিক মহাসাগরে তাদেরকে নিয়ে মহড়া দেয়।
সেখানে সৈনিকদের বলা হলো, এ পানিপথে অনেকেই আক্রমণ করতে আসবে। তাদের যেন গুলি করে হত্যা করা হয়।
কিন্তু তাদের সামনে কোনো শত্রুই পড়েনি। এক মাস পর আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আবার কলম্বোয় ফিরলেন তারা। তখন কলম্বোর কাছাকাছি জার্মানির একটি জাহাজকে তারা ডুবিয়ে দিয়েছিলেন।
পরে সেখান থেকে আবার হায়দরাবাদ নিয়ে আসা হয় তাদের। এরপর তাদের ১৫ দিনের ছুটি দেয়া হয়। ছুটি শেষে আবারও করাচি থেকে মিয়ানমারের দিকে রওনা দেন মান্নান।
প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে হিমালয়ের নিচ দিয়ে মিয়ানমার পৌঁছায় তাদের সেই সৈনিক দলটি। সেখানে কিছু কিছু স্থানে শত্রুপক্ষের সংবাদ পেয়ে গুলিও করেন। মিয়ানমার এসে ক্যাম্প করার পরই তারা সংবাদ পেয়ে যান হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা ফেলা হয়েছে। তখনই যুদ্ধ শেষ হয়।
মান্নান জানান, সামনাসামনি যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজনকেও তিনি হত্যা করেননি। এ ধরনের পরিস্থিতির সামনে তাকে পড়তে হয়নি যুদ্ধের ময়দানে।
বলেন, যুদ্ধের প্রথম ট্রেনিংয়ের সময় তাদের চারটি কথা বুঝিয়ে দেয়া হয়। কাউকে থাপ্পড় দেয়া যাবে না, সম্পদ লুট করা যাবে না, নারীদের যৌন নির্যাতন করা যাবে না এবং মিথ্যা বলা যাবে না।
দেশে ফিরলেন কীভাবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হিরোশিমায় যখন বোমা হামলা হলো, তখন ব্রিটিশ সৈনিকরা আমাদেরকে ভারতীয়দের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে তারা চলে যেতে থাকে। পাঁচ-সাতজন করে একেকটি দল ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছিল। তখন আমরা জানতে চাইলাম আপনারা কোথায় যান? তখন ভারতীয় সৈনিকেরা আমাদের কাছে সত্যটা গোপন করে জানায়, তারা কোয়ার্টারে যাচ্ছে।
‘আর সত্যিটা হলো, সব ব্রিটিশ সৈনিক তখন আমাদেরকে ক্যাম্পে রেখেই ফ্লাইটে করে লন্ডন চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে কয়েক দিনের মধ্যে সকল সাদা চামড়ার অফিসারই চলে গেল।’
তিনি বলেন, ‘হিরোশিমায় বোমা হামলার পর যুদ্ধটা আসলে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে আমাদের আবার হায়দরাবাদে নিয়ে আসা হয়। এরপর আমাদের হাতে মাত্র ৫০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখার গল্পটা শুনতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেই যুদ্ধে গিয়ে আমি তেমন কিছুই পাইনি। এমনকি প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাইনি। এরপর মন চাইল ব্রিটিশ সরকারের কাছে একটি চিঠি লেখার।
‘কিন্তু আমি তো পড়াশোনা জানি না। ইংলিশ বলতে পারি তবে লিখতে পারি না। ইংলিশ লেখার মধ্যে কেবল নিজের নামটাই লিখতে জানি। তাই শরণাপন্ন হলাম আমাদের এলাকার আলতাফ মৌলভীর। তিনি ইংরেজিতে খুব পারদর্শী ছিলেন।’
কী লিখেছিলেন সেই চিঠিতে?
মান্নান বলেন, ‘তখন ছিল এরশাদ সরকারের আমল। ওই সময় লিখেছিলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আপনার ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আমাদের ফেলে কমান্ড ছেড়ে চলে গেল। অথচ আমাকে কিছুই বলে যায়নি। আমার অধিকার আমি পাইনি। যুদ্ধ জয় করে আপনার দেশের সৈন্যরা আমাদের কাছে কিছু না বলে চুপিচুপি সেখান থেকে চলে গেল। এখন লন্ডন শহরে তারা মাথা উঁচু করে হাঁটে। আর আমি যে আপনাদের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিলাম, আমাকেও তো প্রাপ্য সম্মানটুকু দেননি আপনারা। কোনো খোঁজখবরও রাখেননি।’
তিনি জানান, চিঠির একটি কপি তিনি সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও আরেকটি ব্রিটিশ হাইকমিশনে দেন।
কিছুদিন পর ব্রিটিশ রানির চিঠির জবাব আসে আমার কাছে।
রানি কী লিখেছিলেন?
মান্নান বলেন, ‘রানি লেখেন, আপনার বিষয়টি দেখার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে আপনাদের রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বলা হয়েছে। ব্রিটিশ অ্যাম্বাসি থেকে আমাকে চিঠি দেয়া হলো। আপনার বিষয়টি ব্রিটিশ সোলজার বোর্ড থেকে অচিরেই সমাধান করা হবে।’
এরপর সে সময়ে ময়মনসিংহের কাচারীঘাট সোলজার বোর্ডে তাকে ডেকে নিয়ে ৩ হাজার ৫৩৮ টাকা ৭৭ পয়সা দেয়া হয়।
‘তখন কাচারীঘাট সোলজার বোর্ডের অফিসার আমাকে বলেন, আপনি তো কিশোরগঞ্জ থেকে লন্ডনে রাস্তা তৈরি করে ফেলেছেন। আপনি আমাদের ডিঙিয়ে কীভাবে এই কাজ করলেন?
‘আমার সাহসের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আপনার সাহসও অনেক। আমরা অবাক।’
এরশাদের পতনের পর তিনি গ্রেপ্তার হলে কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় মান্নানের ভাতা। পরে আবারও ময়মনসিংহের কাচারীঘাট সোলজার বোর্ড থেকে তিনজন লোক এসে তার খোঁজখবর নেন।
‘তারা বলেছিলেন, আমি ছাড়া আরও ৭৫ জনের সঙ্গে দেখা করেছেন তারা। যাদের সঙ্গে দেখা করেছেন তাদের সবাইকে নাকি ধরে তুলতে হয়, বসাতে হয়। আর আমাকে দেখে তারা অবাক। কারণ, আমি এখনও নিজে নিজে সবকিছু করতে পারি’-বলেন মান্নান।
জানান, এখন নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন তিনি।
এই ব্রিটিশ যোদ্ধা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এলাকার লোকজনকে যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতে পাঠিয়েছেন। তবে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেলেও তিনি সনদ পাননি।
মান্নান জানান, কিশোরগঞ্জের কালিয়াচাপড়া চিনিকলে তিনি নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখন থেকে অবসরে পাঠানোর পর তার পাওনা বুঝে পাননি। তার দাবি, এখনও ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা তাদের কাছে পান।
আপনার শেষ ইচ্ছা কী? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার শেষ ইচ্ছে আমি দেশের মাটিতেই মরতে চাই। তবে ব্রিটিশ সরকার যদি আমাকে তাদের দেশে ভ্রমণের সুযোগ দেয় তাহলে আমি লন্ডনে গিয়ে দেশটা একটু ঘুরে দেখতে চাই।’
মান্নান বিয়ে করেছেন পাঁচটি। বেঁচে আছেন একজন। সব মিলিয়ে ১৭ জন সন্তানের জনক। এর মধ্যে ছয় ছেলে, পাঁচ মেয়ে বেঁচে আছেন। এক ছেলে ছাড়া বাকিরা বিবাহিত।
আবদুল মান্নানের বড় ছেলে মো. আরিফ বলেন, ‘আমার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক এই পরিচয়টা আমাদের জন্য গর্বের। বাবা বিশ্বযুদ্ধের পরে নিজের সম্মানের জন্য আরেকটি যুদ্ধ করেছেন। সেটি হলো একজন ব্যক্তি যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার পরেও নিজের প্রাপ্য সম্মানটা অর্জনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে তৎকালীন সময়েই চিঠি লিখেছেন। এটাও বিরাট সাহসের ব্যাপার ছিল।
‘তার সেই চিঠির জবাবও দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকার। এমনকি এই জবাবের পরেই তার ভাতা চালু হয়েছে। এখনও ভাতা চলমান। যেটা দিয়ে বাবা সুন্দরভাবে চলতে পারেন।’
মেয়ে সেলিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা বইয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনি পড়েছি। বাবার মুখ থেকেও বহু শুনেছি। বইয়ে যেগুলো পড়েছিলাম তার অনেক কিছুই ভুলে গেলেও বাবার মুখ থেকে যেগুলো শুনেছি সেগুলোর একটাও ভুলিনি।’
স্থানীয় বাসিন্দা বছির উদ্দিন বলেন, ‘সৈনিক আব্দুল মান্নান আমাদের দাদা হন। তাকে দেখতে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসেন। কয়েক দিন ধরে সাংবাদিকরা সারা দিনই তার বাড়িতে আসছেন সাক্ষাৎকার নিতে। তিনিও খুব আনন্দ পাচ্ছেন। সারা দিন ড্রেসটা খোলারও সুযোগ পাচ্ছেন না।’