টাঙ্গাইলে নৈশ কোচে ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মধ্যে হোতাকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। সেই সঙ্গে বাসটিতে কী হয়েছিল তারও আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়েছেন পুলিশ সুপার (এসপি)।
এসপি সরকার মোহাম্মদ কায়সার বৃহস্পতিবার প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী ঈগল এক্সপ্রেসের বাসটি সিরাজগঞ্জ রোডে জনতা নামক খাবার হোটেলে যাত্রা বিরতি করে। সেখানে ৩০ মিনিটের মতো বিরতি শেষে বাসটি ফের ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে।
পথে তিনটি স্থান থেকে অজ্ঞাতপরিচয় তিন-চারজন করে মোট ১২ জন ডাকাত যাত্রীবেশে বাসে ওঠেন এবং পেছনের দিকে খালি সিটে বসেন।
যমুনা সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) পার হওয়ার আধা ঘণ্টা পর (রাত দেড়টার দিকে) টাঙ্গাইলের নাটিয়াপাড়া এলাকায় ডাকাতরা বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ছুরি, চাকুসহ দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বাসের চালককে সিট থেকে উঠিয়ে হাত-পা বেঁধে পেছনে সিটের নিচে ফেলে রাখে।
টহল পুলিশের কাছে ধরা পড়া এড়াতে তারা বাসটিকে গোড়াই থেকে ইউটার্ন করে এলেঙ্গা হয়ে ময়মনসিংহ রোড ধরে যেতে থাকে। এই সময়ের মধ্যে ডাকাত দল বাসটির জানালার পর্দা ও যাত্রীদের পরনের বিভিন্ন কাপড় ছিঁড়ে চোখ এবং হাত বেঁধে ফেলে। পরে ডাকাতরা বাসের ২৪ যাত্রীর কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়। বাসের এক নারীকে পাঁচ-ছয়জন ধর্ষণ করে।
এ ঘটনায় বাসের যাত্রী হেকমত আলী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন।
এসপি জানান, ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাটি লোমহর্ষক এবং চাঞ্চল্যকর হওয়ায় পুলিশ গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে। টাঙ্গাইলের একটি টিম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত রাজা মিয়াকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার ত্রিশোর্ধ্ব রাজা মিয়া টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা এলাকার বাসিন্দা বলে জানান এসপি। বলেন, রাজা টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। বুধবার রাতে টাঙ্গাইল শহর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তার কাছ থেকে ছিনতাই করা তিনটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
রাজা মিয়া টাঙ্গাইল-চন্দ্রা পথে চলাচলকারী ঝটিকা পরিবহনের বাসের চালক। বাসটির মূল চালক মনিরুল ইসলাম মনিরকে সরিয়ে রাজা মিয়া বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেন। প্রায় প্রায় ৩ ঘণ্টা সেটি তার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
তিনি আরও জানান, অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার ও বাসযাত্রীদের কাছ থেকে ডাকাতি হওয়া মালামাল উদ্ধারে অভিযান চলছে। গ্রেপ্তার আসামিকে সাত দিন রিমান্ডে নিতে আবেদন করবে পুলিশ।
‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ শিকার নারী যা বললেন
সংবাদমাধ্যমের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ওই নারীও। তিনি বলেন, ‘আমি কুষ্টিয়ার একটি জায়গা থেকে উঠি। সিরাজগঞ্জের হোটেলে রাত সাড়ে ১১টায় এসে পৌঁছাই। খাওয়া-দাওয়া শেষে গাড়ি চলল। তার কিছুক্ষণ পরই তিনটা ছেলে ওঠে।
‘তারপর তারা বলে, আমাদের আরও লোক আছে সামনে। তখন আরও চারটা লোক ওঠে। তার মধ্যে আরেকজন বলে, সামনে আমার আরও লোক আছে। সিরাজগঞ্জের মধ্যে আরও ছয়জন ওঠে। তাদের পেছনে সিট দিয়ে দেয়।’
নিজেকে একজন পরিবহন শ্রমিকের স্ত্রী দাবি করে ওই নারী বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর তিনজন ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বলে, আমরা নামব। তার পরই ড্রাইভারের গলায় চাক্কু বাধায়। তারপর ড্রাইভার ও হেলপারকে তুলে নিয়ে চলে আসে। বাসের পেছনের দিকে নিয়ে এসে আটকায়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কন্ডাক্টরকেও তুলে নেয়।’
ওই নারী আরও বলেন, ‘তারপর যাত্রীদের মধ্যে বেটা ছেলেদের সবাইকে বেঁধে ফেলে। মুখও বেঁধে ফেলে। পরে মেয়েদেরও বেঁধে ফেলতে শুরু করে। টাকা-পয়সা-মোবাইল সবই কেড়ে নেয়। কারও গয়নাও নিয়ে নেয়।
‘একপর্যায়ে আমার গলা চেপে ধরে। ছয়জন আমাকে ধর্ষণ করে। পরে বিভিন্ন জায়গায় গাড়ির গতি কমিয়ে ডাকাতরা নামতে থাকে। একসময় হঠাৎ ডাকাত দলের চালক গাড়ির জানালা দিয়ে নেমে যায়। গাড়িটি খাদে পড়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসে। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসে উদ্ধার করতে। যাত্রীরা জানালা দিয়ে বের হয়ে আসে। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের কাছে তারা ডাকাতির ঘটনা বলেন। আমাকে প্রথমে মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বুধবার রাতে ভর্তি করা হয় টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে।’
ওই নারীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য মেডিক্যাল টিম গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেহেনা পারভীন বলেন, ‘তিন সদস্যের মেডিক্যাল টিম ওই নারীকে পরীক্ষা করেছে। কিছু সাইন পজিটিভ আছে। সাইন অব স্ট্রাগল রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার সোয়াব সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’