গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর দর সংশোধন শুরু হওয়ার পর নানা ঘটনায় ধস নামা পুঁজিবাজার অবশেষে ঘুরে দাঁড়িয়ে দারুণ একটি সপ্তাহ পার করল।
প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার পর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট শেয়ারের ক্রয়মূল্যে গণনার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি প্রকাশ্যে আসার পর টানা পাঁচ কর্মদিবস বাড়ল সূচক।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর টালমাটাল বিশ্বে অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দেশে পুঁজিবাজার ক্রমেই নিম্নমুখি হওয়ার মধ্যে বিনিয়োগকারীরা যখন হতাশায় মুষড়ে পড়েছে, সে সময় চলতি সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইসর সাধারণ সূচক বাড়ল ৩৩১ পয়েন্ট।
আগের সপ্তাহের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
চলতি সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবস মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে মোট ৫ হাজার ৫৮ কোটি ৬৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন ছিল ৩ হজার ১৬৯ কোটি ১৯ লাখ ৮২ হাজার টাকা। বেড়েছে এক হাজার ৮৮৯ কোটি ৪৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
চার কর্মদিবসে ৩১৯ পয়েন্ট সূচক বাড়ার পর বৃহস্পতিবার সূচকের উঠানামা ছিল বেলা দেড়টা পর্যন্ত। তবে শেষ এক ঘণ্টায় সূচক বাড়ে ৩০ পয়েন্ট। আর এর মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত আগের দিনের অবস্থানের সঙ্গে যোগ হয় ১২ পয়েন্ট।
দিন শেষে সূচকের অবস্থান গত ১৪ জুলাইয়ের পর সর্বোচ্চ। সেদিন সূচক ছিল ৬ হাজার ৩২৪ পয়েন্ট। সেখান থেকে ধস নেমে ১০ কর্মদিবসে কমেছিল ৩৪৩ পয়েন্ট।
অর্থাৎ ১০ দিনের ধসে যতটা পতন, এবার উত্থান হলো তার দ্বিগুণ গতিতে।
দিনভর হাতবদল হয়েছে এক হাজার ১৯০ কোটি ২৬ লাখ ৫ হাজার টাকা। যদিও আগের দিনের চেয়ে কিছুটা কমেছে।
Caption
পুঁজিবাজারের সূচক সাত হাজার পেরিয়ে যখন আট হাজারের পথে যাওয়ার আশাবাদ তৈরি হচ্ছিল, তখন গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ শুরু হয় বাজার সংশোধন। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুঁজিবাজার। কিছুদিন বড় মূলধনি কিছু কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ার পর সূচক বাড়লেও বেশিরভাগ কোম্পানি দর হারাতে থাকে।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে নানা ইস্যুতে মতবিরোধের বিষয়টি সামনে আসে। এরপর বছর শেষে সমন্বয়, শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ইত্যাদি ইস্যুতে এক বছরের কম সময়ে প্রায় দেড় হাজার পয়েন্ট সূচক কমে গিয়ে তৈরি হয় হতাশা, ক্ষোভ।
এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বিএসইসি দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস দেয়।
- আরও পড়ুন: ধস ঠেকাতে ফিরল শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস
তার আগেই ১৮ জুলাই ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিটের গণনাপদ্ধতি পাল্টানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে। মন্ত্রণালয় থেকে পাল্টা চিঠি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যায় মঙ্গলবার। এতে মন্ত্রণলয় একটি কৌশলী মতামত দেয়। মন্ত্রণালয় বলছে, শেয়ারের ক্রয়মূল্যকেই বাজার মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এই দুই ঘটনাই মূলত হতাশায় ডুবে যাওয়া পুঁজিবাজারকে টেনে তুলতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় হচ্ছেন। বিএসইসি বিনিয়োগ আরও বাড়াতে নানামুখী চেষ্টা করছে।
এর পাশাপাশি অর্থনীতির যে সূচকগুলো এতদিন ভয় দেখাচ্ছিল, সেগুলোও এবার স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমদানি কমছে, বাড়লে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি। এর সুবাদে নিম্নমুখি রিজার্ভ ইউটার্ন দিয়ে আবার ৪০ বিলিয়ন ডলারের দিকে ছুটছে। জুলাই শেষে জানানো হয়, মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমেছে।
আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন নিউজবাংলাকে বলেন, 'ফ্লোর প্রাইজের কারণে দরবৃদ্ধি শুরু হয়। এরপরে মঙ্গলবারে অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকের কক্সবাজার লিমিট কস্ট প্রাইসে কাউন্ট করার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত জানায় তার কারণেই সপ্তাহজুড়ে বাজারের এই উত্থান।
'তবে কয়েক দিনের উত্থানের পরে আজ প্রফিট টেকিংয়ের প্রবণতা দেখা গেছে। যার কারণে সূচকে একটু পয়েন্ট কম যোগ হয়েছে।'
সংকটাপন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দর বাড়ছেই
সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের। পর পর দুই দিন বাড়ল তিন বছর ধরে লোকসানে থাকা কোম্পানিটির। ১০ শতাংশ বেড়ে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৮ টাকা ৮০ পয়সায়।
শীর্ষে দশে জায়গা করে নিয়েছে লোকসানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স এবং ফাস ফাইন্যান্স যে দুটি ঋণ কেলেঙ্কারিতে জর্জর হয়ে বিপুল পরিমাণ লোকসান দিয়েছে।
দর বৃদ্ধির দ্বিতীয় স্থানে ছিল গত বছর তালিকাভুক্ত হওয়া একমি পেস্টিসাইডস, যার দরও বেড়েছে ১০ শতাংশ। সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসেই দর বেড়েছে কোম্পানির।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের। ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ দর বেড়েছে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ১৩৬ টাকা ১০ পয়সায়। এ নিয়ে ৫ দিনই দর বাড়ল।
কেপিপিএল, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যালস, ফারইস্ট নিটিং ও ম্যাকসনস স্পিনিং মিলসও ছিল দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে।
দর পতনের শীর্ষ ১০
সবচেয়ে বেশি দর কমেছে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের। ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ দর কমে সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ২৬ টাকা ৭০ পয়সায়।
৪ দশমিক ৮১ শতাংশ দর কমেছে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। প্রতিটি শেয়ারের ক্লোজিং প্রাইস দাঁড়িয়েছে ১৪৮ টাকা ৪০ পয়সায়।
এর পরেই ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ দর কমে সর্বশেষ ৩০ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার।
এ ছাড়া তালিকায় রয়েছে যথাক্রমে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, আইসিবি এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ৫ দশমিক ১২ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে ওয়ালটন হাইটেক। কোম্পানিটির দর ১ দশমিক ৯২ শতাংশ দর বেড়েছে।
গ্রামীণফোনের দর শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ২ দশমিক ২২ পয়েন্ট।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ সূচকে যোগ করেছে ২ দশমিক ০১ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
এ ছাড়া স্কয়ার ফার্মা, লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, ম্যারিকো, একমি ল্যাবরেটরিজ, ওরিয়ন ফার্মা, বেক্সিমকো লিমিটেড ও বার্জার পেইন্টস সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট।
অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ২৯ পয়েন্ট সূচক কমেছে রবির দর পতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৯১ পয়েন্ট কমিয়েছে বিকন ফার্মা। কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৭৬ পয়েন্ট।
এ ছাড়া পাওয়ার গ্রিড, আইপিডিসি, এনআরবিসি ব্যাংক, তিতাস গ্যাস, সিটি ব্যাংক, এমজেএল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৫ দশমিক ৯২ পয়েন্ট।