এক হাত তুলায়, আরেক হাত চরকায়। গড়গড় শব্দে সুতা কেটে চলেছেন একদল নারী। গভীর মনোযোগে তাদের সকাল গড়িয়ে কখন যে দুপুর হয়ে যায় খেয়ালই থাকে না।
এমন মনোযোগের পরও দিনে মাত্র এক থেকে দুই গ্রাম সুতা কাটতে পারেন একেকজন। কারণ এই সুতাটি এত মিহি যে, সহজে কাটা যায় না। এমনকি মেশিনেও কাটা সম্ভব নয়। ছিঁড়ে যায়। তাই ধীরে ধীরে হাত দিয়ে কাটতে হয় সুতাটি।
কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল মিহি এই সুতা দিয়েই ফিরে আসছে অতীতের হারানো গৌরব। তৈরি হচ্ছে মসলিন কাপড়। আর এই কাপড় দিয়েই বানানো একটি শাড়ির পেছনে খরচ হচ্ছে প্রায় সাত লাখ টাকা!
চান্দিনার সোনাপুর, দোতলা আর দেবিদ্বারের রামপুর- কুমিল্লার এই তিনটি গ্রামই এখন বহু মূল্যবান সেই শাড়ির আঁতুড় ঘর। এই গ্রামগুলোর সাতটি স্থানে ২২৬ জন নারী এখন মসলিনের সুতা কাটেন। তাদের তৈরি সুতা চলে যায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। সেখানেই বিখ্যাত মসলিন কাপড় বুনছেন ২৩ জন কারিগর।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ফুটি কার্পাস তুলা থেকেই তৈরি হয় মসলিনের সুতা। চরকা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ মেট্রি কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হতো। বলা হয়, একটি আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে বের করে আনা যায় একটি মসলিন শাড়ি। নানা কারণে ১৮ শতকের শেষ দিকে বাংলায় মসলিন কাপড় তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।
মঙ্গলবার দুপুরে চান্দিনার সোনাপুর গ্রামের মুন্সীবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি টিনের ঘরে দুটি কক্ষে চরকায় সুতা কাটছেন ৪৫ নারী। তাদের সুপারভাইজার রোকসানা আক্তার জানান, সোনাপুর ও আশপাশের গ্রামে আগে মোটা সুতা কাটা হতো। ৬ বছর আগে তাঁত বোর্ড থেকে তাদের ৪০ জনকে মসলিন কাপড়ের সুতা কাটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে ছয়জনকে বাছাই করা হয়। ওই ছয়জন পরে তিন গ্রামের ২২৬ নারীকে প্রশিক্ষণ দেন।
রোকসানা বলেন, ‘গত বছর সময় ধরে আমরা মসলিন সুতা কাটছি। সকাল ৭টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সুতা কাটি। প্রতিদিন ২৫০ টাকা মজুরি পাই।’
এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত নাজমা বেগম, বিলকিস আক্তার জানান, তারা গ্রামের মধ্যে নিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে পারছেন। এক বেলা কাজ করে, অন্য বেলা পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। এতে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে সংসারে কিছুটা সচ্ছলতাও এসেছে।
সোনাপুর গ্রামের মধ্যপাড়া কেন্দ্রের সাফিয়া বেগম বলেন, ‘মজুরি আরেকটু বাড়ালে আমাদের সুবিধা হয়।’