আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চরিত্র একই। আর নির্যাতিত বিধায় বিএনপিকে আন্দোলনে চাইলেও তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়া যাবে না- গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরের এমন বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানালেন না বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে তৃতীয় শক্তি হওয়ার মানসে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে নতুন জোট নিয়ে আসছে যে কয়টি দল, তাদের মধ্যে আছে নুরের গণঅধিকার পরিষদও।
সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়তে বিএনপির ধারাবাহিক আলোচনার অংশ হিসেবে বুধবার পল্টনে গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয়ে নুরের দলের সঙ্গে সংলাপে বসে বিএনপি।
সকাল ১১টায় শুরু হওয়া ওই বৈঠকে গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া, সদস্য সচিব নূরুল হক নুর, সিনিয়র সদস্য সচিব রাশেদ খান উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন।
সংলাপ শেষে ফখরুলের কাছে গণমাধ্যমকর্মীরা নুরের আগের দিনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চান।
সেদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে নতুন জোট গঠনের ঘোষণার পর নুর আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে একই পাল্লায় দেখার কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা গত ৩৪ বছরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলকেই ক্ষমতায় দেখেছি। আমরা দুই দলেরই চরিত্র দেখেছি। তাদের চরিত্র একই। এই দুই দল ক্ষমতায় থাকলে জনগণের কিছুই হবে না। এ জন্য তৃতীয় কোনো শক্তিকে আমাদের ক্ষমতায় নিতে হবে।’
বিএনপির সঙ্গে ঐক্য গড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে আমাদের ঐক্য গড়তে হবে। এই ঐক্যে একটা নির্যাতিত দল হিসেবে বিএনপিকে সঙ্গে রাখতে পারি। কিন্তু তাদের হাতে ক্ষমতা ছাড়া যাবে না।’
গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে সংলাপ শেষে নুরের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নূর সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দেবেন।’ নুর জবাব দিতে গিয়ে আগের দিনের বক্তব্যের বিপরীত কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ৩৪ বছর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। আমি দেখেছি, তাদের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় অনেক কিছুরই মিল থাকে। … বিএনপি তো তার পুরনা অবস্থান থেকে সরে এসে… তারা নির্বাচন পরবর্তীতে পুরনা ব্যবস্থার পরিবর্তনে একটা জাতীয় সরকারের ঘোষণা দিয়েছে।
‘আমরা এখানে যে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলছি, সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছদের পরিবর্তনসহ বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন বাতিল করা। সেখানে বিএনপি একমত পোষণ করেছে।’
ফখরুল বলেন, ‘আমি বলতে চাই, বিএনপি কী করেছে না করেছে এটা দেশের মানুষ সবাই জানে।’
সাংবাদিকেদের বিএনপি নেতা বলেন, ‘আপনারা সব সময় ইতিবাচক দিকগুলোকে সমর্থন করবেন। জাতির বর্তমান যে অবস্থা সেখানে শুধু বিএনপি কিংবা গণঅধিকার পরিষদ নয় লড়াই করলেই সফলতা আসবে না। আপনাদের অবস্থান থেকেই আপনাদের লড়াই করতে হবে। আপনাদের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য।
গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণসংহতি আন্দোলন আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুর। ছবি: নিউজবাংলাযুগপৎ আন্দোলনে একমত দুই দল
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে দুই সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে একমত হয়েছে বলে জানানো হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় খুশি হয়েছি যে তারা আমাদের সঙ্গে সবগুলো বিষয়ে একমত।
‘আমরা একমত হয়েছি যে, সরকারবিরোধী ঐক্যবদ্ধ যুগপৎ আন্দোলন আমরা করব এবং এ আন্দোলনের পরে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, তারপর সকালের মতামতের ভিত্তিতে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করা।
‘তার মাধ্যমে একটি জনগণের সংসদ তৈরি করা, একটি সরকার গঠন করা যারা সত্যিকার অর্থে জনগণের সরকার। রাষ্ট্র মেরামতের জন্য আমরা জাতীয় সরকারের মতো সরকার গঠন করব।’
গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর আমরা বলেছি যে, একই পথে একই চিন্তায় আমরা আছি। আমাদের মধ্যে খুব বেশি ব্যাপারে দ্বিমত নেই।’
১০ বিষয়ে ঐক্যমত
নূর জানান, তারা মোট ১০টি বিষয়ে একমত হয়েছেন।
সেগুলো হলো:
১. ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণের ভোটবিহীন জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার হঠাতে যুগপৎ বা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রাম।
২. অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ইভিএম বাতিল করে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোটগ্রহণ।
৩. রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনায়নসহ সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার।
৪. বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে প্রধান বিচারপতিসহ বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন।
৫. বাক, ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার অধিকারসহ নাগরিকদের সংবিধান স্বীকৃত সকল অধিকার প্রতিষ্ঠা।
৬. খালেদা জিয়াসহ সকল ‘রাজবন্দি’ ও ধর্মীয় নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। ভিন্নমতের উপর রাষ্ট্রীয় দমন, পীড়ন, গুম, খুন, নির্যাতন-নিপীড়ন, হামলা- মামলা বন্ধে পদক্ষেপ৷
৭. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল গণবিরোধী ও নিপীড়নমূলক আইন বাতিল করা।
৮. বর্তমান সরকারের গত ১৩ বছরের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের শ্বেতপত্র প্রকাশ করে দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ।
৯. মেগা প্রকল্প ও কুইক রেন্টালের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘লুটপাটের সঙ্গে’ জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচার নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আইন করে বাপেক্সেকে শক্তিশালী স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।
১০. রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেশ, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বসহ জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা।