বিদ্যুতের দাবিতে রক্ত দেয়া একমাত্র জনপদ এটি। ১৬ বছর আগের সেই বিপ্লব আর প্রাণহানির স্মৃতি আবার জেগে উঠেছে জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারের লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার গ্রাম কানসাটের কথা কজনাই বা জানত দেশে? কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের শেষ বছর ২০০৬ সালে নজিরবিহীন বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে জানুয়ারির তীব্র শীতে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গে এলাকা তো বটেই, সারা দেশকেই উত্তপ্ত করে তুলেছিল কানসাটবাসী।
পুলিশের গুলি, একের পর এক রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখেও পিছু হটেননি বিদ্যুতের দাবিতে সোচ্চার বাসিন্দারা। পুলিশের গুলিতে ২০ জনের প্রাণহানি আর শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় রাজধানীতে সে সময়ের সরকারের অবস্থানই টলে যাওয়ার দশা তৈরি হয়।
তখন থেকেই কানসাটে বিদ্যুৎ সরবরাহে থাকে বাড়তি নজর। এবার দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ের মধ্যেও একটু কদর করা হচ্ছে জনপদটিকে।
বিদ্যুতের যাওয়া-আসা একেবারে নেই, এমন নয়। তীব্র গরমে যাওয়া-আসা আছে, এর মধ্যে রাতে যখন চাহিদা বেশি থাকে, তখন লোডশেডিং একটু বেশিই হয়। তবে সে জন্য ক্ষোভ খুব একটা আছে এমন নয়, বৈশ্বিক জ্বালানিসংকটের মধ্যে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেই উপলব্ধি আছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
কানসাটের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কেমন তা জানতে শনিবার নিউজবাংলা গিয়েছিল কানসাটে।
সকাল ৯টায় দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার গোপালনগরের মোড়ে যানজটের বাধা। সেটি পেরিয়ে কানসাট মসজিদ মোড় এলাকায় পৌঁছে কয়েকটি মোবাইল, কম্পিউটার কম্পোজ ও ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানে কথা হয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান মালিক মো. পারভেজ বলেন, ‘মোটামুটি ভালোই বিদ্যুৎ পাই আমরা। ইদানীং একটু লোডশেডিং হচ্ছে, তারপরও বিদ্যুৎ খুব যে খারাপ পাচ্ছি তা না।’
কিছুদূর এগিয়ে কানসাট ক্লাব সুপার মার্কেটের সামনে নিমতলায় একটা চায়ের দোকানের সামনে পৌঁছতে পৌঁছতে ঘড়িতে সাড়ে ৯টা। দোকানগুলো খোলা, বাতি জ্বলছিল, আনাগোনা ভালোই ছিল ক্রেতাদের।
চায়ের দোকানে বসেই কথা হয় স্থানীয় যুবক নাদিম হোসেনের সঙ্গে। তিনিও কথা বললেন পারভেজের সুরেই। জানালেন, কানসাট মার্কেট ও এর আশপাশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো। লোডশেডিং কমই হয় সেখানে।
তার কথায় আরেকজন বললেন, ‘এখানে (মার্কেটে) কারেন্ট থাকলেও বাড়িতে কারেন্ট থাকে না, রাতে বেশি ভোগান্তি।’
কানসাট মার্কেটের কাপড় দোকানের মালিক গোলাম মুর্তুজা বলেন, ‘কারেন্ট যায় যখন, তখন আমরা আইপিএস দিয়ে ম্যানেজ করি। তবে আজ সকাল থেকে কারেন্ট যায়নি, হয়তো দুপুরের পর যাবে। কখন যায় যেটা বলা যাচ্ছে না, গেলে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর আবার আসে।’
তার দোকানেই বসেছিলেন এনামুল হক নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তার কথায় উঠে এলো বিদ্যুতের দাবিতে সাড়ে ১৬ বছর আগের সেই আন্দোলনের কথা।
তিনি বলেন, ‘তখনকার অবস্থা প্যালিয়া গেলে (বিদ্যুৎ চলে যাওয়া) পাঁচ ঘণ্টা নাই। ঘর থ্যাকা বাহিরা ডহার ডহার হ্যাটা ব্যাড়াতে হয়্যাছে (বিদ্যুৎ না থাকলে ঘর থেকে বের হয়ে এখানে সেখানে ঘুরতে হয়েছে)। যখন বিদ্যৎ অ্যাসছে তখন যায়া ঘরে ঢুকতে হয়্যাছে। আজক্যা দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দিয়্যাও তো শান্তি পাছি, সে আমলে তো দুই ঘণ্টা পরেও পাইনি (বিদ্যুৎ)। কষ্টের মধ্যে ভালো থ্যাকাছি।’
মার্কেট থেকে বের হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই এলাকায় থেকে বিদ্যুৎ যেতে দেখা যায়নি।
এরপরের গন্তব্য কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানীর বাসায়। দুপুর পৌনে ১টায় কানসাটের পুখুরিয়া এলাকায় বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
বাসায় থাকা কেয়ারটেকারকে বারান্দায় বসে টিভি দেখতে দেখা যায়। বিদ্যুৎ কেমন থাকে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আজকে যায়নি সকাল থেকে, তবে যায় মাঝেমধ্যে।’
সে সময় রাজনীতি না করা রাব্বানী এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। সেই আন্দোলনের আগে এলাকায় বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অবস্থান দুর্বল থাকলেও নৌকার প্রার্থীরা পরে অবস্থান সংহত করে নেন।
রাব্বানীর বাড়ি থেকে বের হয়ে পুখুরিয়া এলাকার হঠাৎপাড়া এলাকায় একটি বাড়িতে নক করতেই বের হয়ে এলেন মাসুদ রানা নামের একজন। বিদ্যুৎ কেমন পাচ্ছেন জানতে চাইলে শ্রমজীবী মানুষটি জানান, ‘রাতে বেশি জ্বালায়’।
১৪৪ ধারা জারির পর পুলিশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ সড়কের বেকির মোড় থেকে কানসাট বাজার পর্যন্ত কঠোর অবস্থান নেয়। ছবি: সংগৃহীততার সঙ্গে কথা বলার সময় বাড়ির ভেতর থেকে এক নারী কণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, ‘দিনে কারেন্ট না থাকলে তাও বাগানে একটু ঘুরাফিরা চলা যায়, কিন্তু রাতে কারেন্ট গ্যালে কষ্ট সহ্য করা যায় না।’
কানসাট ইউনিয়নে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। শিবগঞ্জ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো। তাদের জন্য গোটা উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা দিনে ১৫ মেগাওয়াট, রাতে সেটি ওঠে ২৩-এ। এর বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ দিনে ১০ থেকে ১১ মেগাওয়াট, অন্যদিকে রাতে ১২ থেকে ১৩।
উপজেলায় ইউনিয়ন সংখ্যা ১৫টি আর বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বেশ ফারাক থাকলেও কানসাটের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো কেন, সেটি জানা গেল কানসাটে পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসে গিয়ে।
২০০৬ সালের আন্দোলনের পর কানসাট বাজার এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনটি একটি আলাদা ফিডারে দেয়া হয়। ওই এলাকায় আধা মেগাওয়াট লোড প্রয়োজন পড়ে, ফলে খুব বেশি সমস্যা না হলে ওই এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং খুব একটা দেয়া হয় না। আমের মৌসুম হওয়ায় বিভিন্ন আড়ত ও বাজারের কথা চিন্তা করেই এমনটা করা হয়েছে।
তবে অন্য এলাকায় সরবরাহে যে ঘাটতি থাকে তার ওপর নির্ভর করে হয় লোডশেডিং।
জেলাজুড়েই পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা উল্লেখযোগ্য। জেলার সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম জানান, জেলায় তাদের গ্রাহক ৩ লাখ ২০ হাজার। চাহিদা ৮০ মেগাওয়াট। বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা হয় ৪৫ থেকে ৫০ মেগাওয়াট। ঘাটতি মোকাবিলায় করা হয় লোডশেডিং।
শিল্প এলাকা, উপজেলা সদর, থানা ও হাসপাতাল এলাকায় কম লোডশেডিং করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি ঘোষিত শিডিউল মেনে লোডশেডিং করার।’