কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
সেই হত্যার ২ বছরে এসে মামলায় মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর চেয়েছেন সিনহার মা ও বোন।
নিহত সেনা কর্মকর্তার মা নাসিমা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছেলে ছিল আমাদের প্রাণের উৎস। যখনই সুযোগ পেয়েছে, মানুষের কল্যাণে এগিয়ে গেছে। যে নরপিশাচরা সিনহাকে হত্যা করে আমার বুক খালি করেছে, তাদের কোনো দিন ক্ষমা করব না। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রেখেছি।
‘প্রত্যাশা একটাই, যারা আমার ছেলেকে হত্যা করে বুক খালি করেছে, সেসব নামধারী নরকের কীটদের যেন দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিচারের রায় কার্যকর হবে। এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে মানুষের জন্য। যেন আর কেউ এভাবে কোনো মায়ের বুক খালি করার দুঃসাহস না পায়।’
সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রদীপ কুমার দাশ (বাঁয়ে) ও লিয়াকত আলী। ছবি:সংগৃহীত
মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস সাংবাদিকদের জানান, উচ্চ আদালতে মামলাটি আপিলে রয়েছে। এ পর্যন্ত মামলা যতটুকু এগিয়েছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট। এখন উচ্চ আদালতে দ্রুত শুনানি শেষে বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
তিনি আরও জানান, মামলার আসামিদের মধ্যে যারা খালাস পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
দ্রুত শুনানি শেষে ভাইয়ের হত্যার ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছেন শারমিন।
দুই বছরে এসে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘রায়ের পর বিচারিক আদালতের সব কাগজপত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের পক্ষে হাইকোর্টে দুটি আপিলও করা হয়েছে। খালাসপ্রাপ্তদের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের কথা ছিল। তা হয়েছে কি না, জানা নেই।
‘স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের আপিলের শুনানিতে সময় লাগে। আদালত কখন শুনানি করে, তা দেখার অপেক্ষায় আছি, তবে গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানি দ্রুত করা জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘বিচারিক আদালতের রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে আশা করি। একটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার জাতি দেখবে।’
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, ‘খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের মেয়াদ ৩১ জুলাই শেষ হচ্ছে। আপিলের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নই, তবে উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের আপিলের শুনানি দ্রুত করে এর বিচার নিশ্চিত করা হোক।’
সিনহা হত্যা মামলা
সিনহা নিহত হওয়ার পরদিন ১ আগস্ট এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে।
সরকারি কাজে বাধা ও মাদক আইনে মামলা দুটি করা হয়। টেকনাফ থানায় করা মামলায় সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। রামু থানায় মাদক আইনে করা মামলাটিতে আসামি করা হয় নিহত সিনহার অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।
একই বছরের ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ৯ পুলিশ সদস্যের নামে কক্সবাজার আদালতে হত্যা মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ (পরিদর্শক) লিয়াকত আলীকে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন টেকনাফ থানার তৎকালীন বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া ও এসআই টুটুল।
মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্তের পর আদালত তদন্তভার দেয় র্যাবকে। একই সঙ্গে পুলিশের করা মামলা তিনটিও র্যাবকে তদন্তের আদেশ দেয় আদালত।
আসামিদের গ্রেপ্তার
২০২০ সালের ৬ আগস্ট সকালে সিনহা হত্যা মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকেলে ৯ আসামির মধ্যে ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই দিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা নামের কোনো পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে কর্মরত ছিল না। পরে আত্মসমর্পণকারী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
র্যাব মামলার তদন্তকালে পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে ১১ আগস্ট গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলা হয়। তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
১৮ আগস্ট এপিবিএনের তিন সদস্য সহকারী উপপরিদর্শক শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে র্যাব আদালতে তোলা হয়। তাদেরও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
১৪ সেপ্টেম্বর কনস্টেবল রুবেল শর্মাকেও গ্রেপ্তার করে আদালতে নেয়া হয়। কারাগারে থাকা এ ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এর মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
১৩ ডিসেম্বর র্যাব-১৩ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এর মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিলেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়।
৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। একই সঙ্গে পুলিশের তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে অব্যাহতি দেয়।
এরপর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে মামলার কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে বদলি করা হয়।
পরের বছর ২০২১ সালের ২৪ জুন সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত ওই দিনই তাকে কারাগারে পাঠায়।
বিচার কার্যক্রম
২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেয়। একই সঙ্গে সাক্ষ্য গ্রহণে ২৬ থেকে ২৮ জুলাই দিন নির্ধারণ করে, কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আদালতের বিচারকাজ স্থগিত থাকায় নির্ধারিত সময়ে সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
পরে ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় জবানবন্দি দেন।
সবশেষ ২০২২ সালের ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি মামলার উভয় পক্ষের আইনজীবী যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক শেষে আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করে।
চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বিকেলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৫ আসামির দুজনকে মৃত্যুদণ্ড, ছয় জনকে যাবজ্জীবন ও সাত জনকে খালাস দেয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন হলেন টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী। তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখতে বলেন বিচারক।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দীন।
খালাস পাওয়া সাত জন হলেন এপিবিএনের এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল মো. রাজীব, মো. আব্দুল্লাহ, পুলিশের কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, লিটন মিয়া ও আব্দুল্লাহ আল মামুন।
মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। প্রতিবেদনে কী ধরনের বিষয়বস্তু উল্লেখ ছিল তা প্রকাশ পায়নি। একই ইস্যুতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ একযোগে দেড় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে অন্য জেলায় বদলি করা হয়।