বগুড়ার গাবতলীর লাঠিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে মারধরের অভিযোগে থানায় সাধারণ ডায়েরি- জিডি হয়েছে। গত সোমবারের ওই ঘটনায় অধ্যক্ষ রুস্তম আলীর করা জিডিতে মারধরের কোনো কারণ জানাননি।
অবশ্য অনেকেই বলছেন, এর মূলে রয়েছে কলেজের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার ভাগাভাগি।
কমিটি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই দাবি করে অধ্যক্ষ রুস্তম আলী বলেছেন, কলেজের উন্নয়ন কাজে বাধা দিতেই এই হামলা হয়েছে।
অধ্যক্ষ রুস্তম আলীর করা জিডিতে বলা হয়, গত সোমবার সকালে কলেজে যাওয়ার পথে নামাদাঁড়াইল নামক স্থানে তার অটোরিকশার গতিরোধ করেন কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি। তারা ওই শিক্ষককে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি মারেন।
রুস্তম আলী লাঠিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ২৪ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। গত ২৪ এপ্রিল তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পান। ১০ মাস আগে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ রোকেয়া পারভীন অবসরে গেলে আব্দুল জলিল নামে আরেক শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পরে রাজশাহী বোর্ড থেকে রুস্তম আলীকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়।
দায়িত্ব পেয়ে গত মে মাসে অধ্যক্ষের সুপারিশে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটির সভাপতি হন মোমিনুল হক শিলু। তিনি গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। এ ছাড়া কমিটিতে আরও চারজন সদস্য রয়েছেন।
হামলার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রুস্তম আলী বলেন, ‘নজরুল, এনামুল, আজাদুর, পাপুলসহ অন্তত ২০ জন আমার পথরোধ করেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন দিচ্ছি না সে জন্য তারা গালিগালাজ করে আমাকে হুমকি দেন কুচি কুচি করে কেটে ফেলবেন বলে।’
হামলার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৬ জুলাই প্রতিষ্ঠানের সভায় আলোচনা সাপেক্ষে স্কুল ও কলেজের উন্নয়নমূলক কাজের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ কাজে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। উন্নয়ন কাজ শুরুর পর থেকেই তারা হুমকি দিতে থাকেন।’
রুস্তম আলী আরও বলেন, ‘সবশেষ সোমবার আমাকে লাঞ্ছিত করে তারা। এ ঘটনায় গাবতলী থানায় একটা জিডি করা হয়েছে, আদালতে মামলাও করা হবে।’
তিনি দাবি করেন, কমিটি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তিনি এই হামলার বিচার দাবি করেন।
অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম দাবি করেন, লাঠিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার পরিবারের অবদান রয়েছে। তার আপন বড় চাচা মোজাম্মেল হক প্রতিষ্ঠানের দাতা সদস্য ছিলেন।
১৯৬৫ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হয়। ২০০২ সালে কলেজ শাখা চালু হয়। আর ২০০৪ সালে এমপিওভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। নজরুল ইসলাম নিজেও ২০০১ সাল থেকে পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি ছিলেন।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না। অথচ শিলু কমিটির সভাপতি হয়ে গেল। তারা গোপনে এই কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হিসেবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে।’
হামলার বিষয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রুস্তম আলীর পথরোধ আমি করিনি। সেখানে উপস্থিতও ছিলাম না। গত শনিবার স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মাঠে অনুষ্ঠান করেছিল। অধ্যক্ষ তাদের অনুষ্ঠানে আসেননি। এমনকি প্রতিষ্ঠানের টয়লেটের রুম বন্ধ করে রেখেছিলেন। এতে ওই ছেলেরা একটু মনঃক্ষুণ্ণ ছিল। এ কারণে তারাই পথরোধ করে। তবে সেখানে মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
ওই দিনের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া কোনো প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনায় আরেক অভিযুক্ত আরএইচএম আজাদুর রহমান একই কথা বলেন। তিনি জানান, লাঠিগঞ্জের স্কুল নিয়ে দুটি গ্রুপ আছে। এক গ্রুপে আছেন শিলু ও শাহাদৎ আলম সাগর। সে গ্রুপটি অধ্যক্ষ রুস্তম আলীকে ব্যবহার করছে। আরেকটি নজরুলের গ্রুপ।
আজাদুর পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফান্ডের হিসাব নিয়ে স্থানীয়ভাবে অনেক কথা ছড়িয়েছে। শিক্ষকদের বেতনের সঙ্গে টিউশন ফি জমা হওয়ার কথা। কিন্তু অধ্যক্ষ রুস্তম আলী সেগুলো দেননি। সেখানে নয়-ছয় হয়েছে।’
আর্থিক বিষয়গুলো প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ রুস্তম আলী বলেন, ‘আগের অধ্যক্ষ অবসরে যাওয়ার আগে কী করেছেন জানি না। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর পরিচালনা কমিটির সভায় সব হিসাব দিয়েছি। শিক্ষকদের কিছু টিউশন ফি পাওনা আছে, এটা সত্যি। তবে সম্প্রতি স্কুল ও কলেজে সংস্কারের কাজে হাত দেয়া হয়েছে। এ জন্য শিক্ষকদের টিউশন ফি বকেয়া রয়েছে, তবে এগুলো তারা পাবেন; এখানে টাকার কোনো নয়-ছয় হয়নি।’
কমিটির রেষারেষির বিষয় নাকচ করে দেন লাঠিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম শিলু। তার দাবি, কমিটি নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই, স্কুলেও কোনো সমস্যা নেই। যারা অধ্যক্ষের ওপর হামলা করেছেন তারা সন্ত্রাসী। তাদের কাজ হুমকি দেয়া, মারধর করা।
নজরুল ইসলামের বিষয়ে সভাপতি শিলু বলেন, ‘উনি স্কুলের কেউ নন। কমিটিতেও নেই। তার স্কুলের বিষয়ে কথা বলারও কিছু নেই, স্কুলের উন্নয়নের কাজের ভাগ নেয়ার জন্য তারা এখন এসব করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের ওপর হামলা করেছে। একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আমার এর বিচার চাই। এ জন্য সব ধরনের আইনগত ব্যবস্থা আমরা নেব।’
মারধরের বিষয়ে করা জিডির তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন গাবতলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘জিডি করার পর এটা আদালত থেকে তদন্তের অনুমতি নিতে হয়। এ জন্য অনুমতিপত্র পাঠানো হয়েছে। আদালতের নির্দেশে সব কাজ করা হবে।’
এ বিষয়ে গাবতলী উপজেলার ইউএনও রওনক জাহান বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। ঘটনা ঘটার পর আমাকে অধ্যক্ষ রুস্তম আলী বিষয়টি মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। বিষয়টি দেখার জন্য পুলিশ, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে।’