বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঠেকাতে ২৭ জুলাই দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে নির্ধারিত সময়ের ১৮ দিন আগে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অথচ এশিয়ার সব থেকে উন্নত কয়লা যেখানে রয়েছে, রংপুরের পীরগঞ্জের সেই মদনখালি কয়লাখনি থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ ঝুলে আছে বছরের পর বছর।সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পীরগঞ্জ থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে বিদ্যুতের বিপর্যয় ঠেকাতে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখত।পীরগঞ্জের খালাশপীর কয়লা খনি প্রকল্পের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে জানান, ১৯৮৯-১৯৯০ পর্যন্ত ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রংপুরের পীরগঞ্জের মদনখালি ইউনিয়নের মাগুড়া গ্রামে এই খনির সন্ধান পায়। ১০ গ্রামের ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে করে ১২ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় খনির সন্ধান পায় সংস্থাটি।চারটি কূপ খনন করে তাতে আট স্তরের এই খনিতে ২২২ মিটার থেকে শুরু করে ৬০৭ মিটার গভীরতায় কয়লা পাওয়া যায়। গড়ে ২৬৫ মিটার থেকে শুরু হয়ে ৩৮৭ মিটারে কয়লার স্তর শেষ হয়েছে। এখানে কয়লা মজুত আছে ৪৫১ মিলিয়ন টন। তার মধ্যে প্রমাণিত মজুত ২৭৭ মিলিয়ন টন এবং অতিরিক্ত আরও ১৭৫ মিলিয়ন টন মজুতের সম্ভাবনা ধরা হয়েছে।ওই কর্মকর্তা জানান, ২০০৩ সালে টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভের জন্য কনসোর্টিয়াম অফ হোসাফ ইন্টারন্যাশনাল ও চায়নার সেনউইন মাইনিং গ্রুপ সরকারের কাছে আবেদন করে। ২০০৪ সালে সরকার অনুমোদন দিলে ২০০৫ সালে জরিপের কাজ শুরু করে তারা।
পীরগঞ্জ কয়লা খনির একজন ভূ-তত্ত্ববিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে জানান, খনিজ জরিপের প্রাথমিক কাজে দ্বি-মাত্রিক ও ত্রি-মাত্রিক সিসমিক সার্ভের জন্য বোরিং করে সুড়ঙ্গপথে খনিতে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরণ করা হয়। তাতে কয়লার মজুত, পুরুত্ব, গভীরতা, চ্যুতি ও কয়লার বিস্তৃতি এবং স্তর সম্পর্কে পরীক্ষা চালানো হয়।
তিনি বলেন, সমীক্ষার পর এই খনিতে বিটুমিনাস গোত্রের কয়লার অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে, যার দহন ক্ষমতা ১ হাজার ৫০০ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (বিটিইউ)। কয়লার কোনো কোনো স্তরে কোকিং কোল নামে এক ধরনের কয়লা রয়েছে, যা দিয়ে যেকোনো ধাতু গলানোর কাজ করা সম্ভব।
অন্য আরেক খনি কর্মকর্তার দাবি, এখানে বিটুমিনাস নামের উচ্চ জ্বালানি ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা রয়েছে। প্রতি পাউন্ড কয়লার জ্বালানি ক্ষমতা ১০ হাজার ৫০০ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (বিটিইউ)। এতে ক্ষতিকর সালফারের উপস্থিতি এক ভাগেরও কম। খনির এক স্তরে ধাতু গলানোর কাজে ব্যবহৃত কোকিং কোল ও চুনাপাথর এবং কাচ বালি রয়েছে, এগুলো অনেক খনিতেই পাওয়া যায় না।
তিনি জানান, সমীক্ষার পর আরও উন্নত ড্রিলিং করা হয়। এরপর কয়লা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে সর্বোচ্চ মান এবং কয়লার মজুত নির্ধারণ করা হয়।তিনি বলেন, ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে হোসাফ গ্রুপ কয়লা খনির সমীক্ষা প্রতিবেদন (ফিজিবিলিটি রিপোর্ট) সরকারের কাছে জমা দিয়ে মাইনিং লিজের জন্য আবেদন করে। তাতে খনিটি ভূগর্ভস্থ (আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং) পদ্ধতিতে উত্তোলন করার কথা বলা হয়েছে।এদিকে হোসাফের জমা দেয়া প্রতিবেদনটি মূল্যায়ন করার জন্য পেট্রোবাংলার হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল মাইনিং কনসালটেড লিমিটেড (আইএমসিএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সংস্থাটি মূল্যায়ন কাজ শেষ করে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারকে জমা দেয়।তাতে বলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে প্রতি বছর ২ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। আর ১০ বছরের টার্গেটে প্রতি বছর ৪ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এর জন্য বিনিয়োগ হতে পারে ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আর প্রতি টন কয়লা বিক্রি হতে পারে ৫০ ইউএস ডলারে।এটি দিয়ে প্রথম ৫ বছর প্রতিদিন ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং কয়লা উৎপাদন বাড়ালে দশম বছরে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।কয়লা খনি প্রকল্পের প্রকল্প প্রধান প্রকৌশলী সামছুদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, সব কাজ শেষে কয়লা উত্তোলন পলিসি কমিটি গঠন করা হয়। তারা সরেজমিনে এসেছিলেন। এরপর আর অগ্রগতি নেই। মন্ত্রণালয়ে ফাইল পড়ে আছে।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি না করে এই কয়লা উত্তোলন করলে এই অঞ্চলে শিল্পায়নে তা সহায়ক হবে। উত্তোলনে সর্বাধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। রংপুরের এই কয়লা উত্তোলন করা হলে দেশের অর্থনীতির চেহারাও পাল্টে যাবে।তিনি বলেন, ‘বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ছাড়া উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য খনিজ সম্পদ উত্তোলনে কোনো উদ্যোগ ও কার্যক্রম দৃশ্যমান হচেছ না। আবিষ্কারের পর তা ঝুলে আছে। আমরা মনে করি, এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব।’
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রথম কথা হচ্ছে স্থানীয় জনগণ বা পরিবেশের ক্ষতি করে বাংলাদেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না বা চলবে না। আধুনিক পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হবে।’বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসানকে তার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।