জনশুমারিতে হিন্দুদের সংখ্যার অনুপাত কমার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বলেছেন, আওয়ামী লীগ এই ধর্মের সদস্যদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু ভোট শেষে অত্যাচার করে, সম্পদ কেড়ে নিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। এ কারণেই তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন বিএনপি নেতা। গত ১৫ জুলাই নড়াইলে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় বিএনপির করা তদন্তের বিষয়বস্তু তুলে ধরতে গণমাধ্যমকর্মীদের এই আমন্ত্রণ জানায় বিএনপি।
আগের দিন সদ্য করা জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এতে জানানো হয়, দেশের জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ এখন হিন্দু ধর্মাবলম্বী । ২০১১ সালের জনশুমারিতে হিন্দু ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১১ বছরে জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত কমেছে দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এই বিষয়টি উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, ‘আজকে পত্রিকায় এসেছে এবারের আদমশুমারিতে ২০১১ সালের চেয়ে হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেছে, যা শতকরা এক ভাগেরও বেশি।’
হিন্দু জনসংখ্যা কমার পেছনে আওয়ামী লীগকে সরাসরি দায়ী করেন বিএনপি নেতা। বলেন, ‘এটাকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। আমরা মনে করি যে গণতন্ত্র না থাকায় এই ঘটনাগুলো ঘটছে অর্থাৎ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যে অধিকার, সেই অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।‘পরিকল্পিতভাবে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে তাদের গৃহ থেকে, জমি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সম্পদ দখল করা তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে আছে। গণতন্ত্রের অভাবেই এটা হচ্ছে। সংখ্যায় কম, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ করে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সম্পদ দখল করাই প্রধান লক্ষ্য বলে আমরা মনে করি।’
ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রচারণা যখন থাকে, তখন তারা বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষক দাবি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের ওপরই অত্যাচারটা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমান্বয়ে এবং ক্রমাগতভাবে অত্যাচার-নির্যাতন বেড়েই চলছে। দেখা যায় যে সম্পূর্ণভাবে তাদের লোকেরাই এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
‘আপনারা যদি পরিসংখ্যান নিয়ে নিরীক্ষা করেন, দেখতে পাবেন আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। হিন্দুদের সম্পদে বেশির ভাগের (দখলের পর) মালিক কিন্তু আপনার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলা বৃদ্ধি পায়। তাদের লোকেরাই এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।’
সাংবাদিকদের নিরপেক্ষভাবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, বাড়িঘর, সম্পত্তি দখলের পরিসংখ্যানগুলো দেখার আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে আসে, তখনই নড়াইলের মতো এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা বাড়ে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের জমিজমা, বাড়িঘর দখল করে। এমনকি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের সময়টাতেও তাদের ওপর বেশি অত্যাচার হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে, তাদের জমিজমা দখল করে নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বান্দরবানের রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, পাবনা, যশোর, অভয়নগর, নাটোর ও নিজের এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন এবং তাদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলার কথা উল্লেখ করেন।
‘হিন্দুরা আ.লীগের বিয়ের দিনের পাগড়ি’
দেশে হিন্দুদের মধ্যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার প্রবণতার বিষয়টি নিয়েও আক্ষেপ করেন বিএনপি নেতা। এই প্রসঙ্গে তিনি তার এলাকায় রাজবংশী সম্প্রদায়ের এক সদস্যের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ‘‘এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের বিয়ের দিনের পাগড়ি। পাগড়িটা এক দিনই পরা হয়।’
বিএনপি নেতা বলেন, “আমার নিজের নির্বাচনি এলাকায় রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ প্রচুর। এক লাখ সাত হাজার ভোটারই আছেন রাজবংশী লোকেরা। তাদের মধ্যে একজন আমার ছাত্রই ছিলেন। নাম ছিল অমর রায়। সে খুব চমৎকার একটা কথা বলত বক্তৃতা দেয়ার সময়ে। আমাদের দেশি ভাষায় ‘হামরা হচ্ছি বিহার দিনের পগরি। মানে, বিয়ের দিনের পাগড়ি হচ্ছি আমরা। একটা দিনই পাগড়িটা পরা হয়, আর কখনও পরা হয় না। নির্বাচনের দিনই ওই পাগড়িটা পরতে হয়, ভোট দেয়ার সময় নৌকাকে ভোট দিতে হয়। আর বাকিটা সময় আমাদের খোঁজ থাকে না’।
“আসলে বিষয়টা তাও নয়। এখানে আওয়ামী লীগ তাদের মনে করে সংখ্যালঘুরা তাদের সম্পত্তি, তারাই এদের রক্ষক, তারা ভোটটোট যা কিছু দেবে, আওয়ামী লীগকে দিতে হবে। আর যা কিছু অত্যাচার-নির্যাতন এবং তাদের সম্পদকে লুট করা, এটাও তাদের।”
নড়াইলে হিন্দুদের ওপর হামলা আ.লীগের কোন্দলে
১৫ জুলাই নড়াইলের লোহাগড়ার দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার পেছনেও আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন ফখরুল। বলেন, ‘নড়াইলের এই ঘটনার সঙ্গে সরকারই দায়ী। প্রতিবেদনে তা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।’
এই ঘটনায় বিএনপির করা তদন্ত কমিটির প্রধান নিতাই চন্দ্র রায়ের দাবি, আওয়ামী লীগের কোন্দলের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে কটূক্তির অভিযোগে এই হামলার ঘটনা ঘটে।
তবে বিএনপি নেতা নিতাই বলেন, ‘ওই গ্রামের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান। এই ঘটনায় বাড়িঘর ভাঙচুর হচ্ছে, দরজা ভেঙে ফেলছে, বাড়িতে আগুন দিয়েছে অথচ এরা (আওয়ামী লীগ) নির্বিকার। কারণ, যিনি চেয়ারম্যান হয়েছেন, তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। আর পাশের গ্রামের আওয়ামী লীগের যে প্রার্থী তিনি পরাজিত হন বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে। এখন দ্বন্দ্বটা শুরু হয় বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী পাস করল কীভাবে? দিঘলীয়া গ্রামের ৭০ শতাংশ ভোটার হিন্দু। হিন্দুরা ভোট দিয়েছে সেই প্রার্থীকে। কেন দিল ভোট? এখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত।’তিনি বলেন, ‘তদন্ত দল সরেজমিনে তদন্ত সাপেক্ষে আক্রান্ত পরিবার এবং স্থানীয় জনসাধারণের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে ঘটনাটি নিশ্চিতভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের গ্রুপিংয়ের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই সংখ্যালঘুদের একটি সহজ উপাদান হিসেবে করা হয়। যেটা অন্যান্য জায়গার মতো নড়াইলেও ঘটেছে।
‘নড়াইল আওয়ামী লীগের সভাপতি সুভাষ বসু, তিনি দুই থেকে তিন দিন পরে ওখানে যান। উপজেলা চেয়ারম্যানও সম্ভবত যাননি। প্রশাসন নির্লিপ্ত এবং এটা সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা। আমরা সেখানে গিয়ে তা সরেজমিন দেখে, ক্ষতিগ্রস্তসহ সাধারণ মানুষের কথা বলে এটা প্রত্যক্ষ করেছি।
‘১৫ তারিখ হঠাৎ করে মাগরিবের নামাজের পরে প্রায় দুই-তিন শত উচ্ছৃঙ্খল লোকজন সাম্প্রদায়িক স্লোগান দিয়ে সাহাপাড়াতে প্রবেশ করে। সেখানে ১০–১২টি বাড়িঘর ভেঙে তছনছ করে, সেখানে বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়, আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মন্দিরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, মন্দিরের প্রতিমা ভাঙে। তার অদূরেই পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। পুলিশের নাকের ডগার ওপর এই ঘটনাটা ঘটল।’