সাড়া ফেলেছে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্প। উপজেলার কামার পুকুর ইউনিয়নের ব্রহ্মোত্তর গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির উঠানে পতিত জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে এ বাগান। অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে নানা রঙের শাক-সবজি। সবুজে ঘেরা সবজির বাগান নজর কেড়েছে মানুষের। তাই এটি এখন সবজি গ্রাম হিসেবে পরিচিত।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, সৈয়দপুরে অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির উঠানে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্পের আওতায় পুষ্টি বাগান তৈরি হচ্ছে। এ জন্য আগ্রহীদের প্রশিক্ষণসহ সার ও বীজ দেয়া হয়েছে সরকারিভাবে।
ব্রহ্মোত্তর গ্রামের কুতুপাড়া এলাকার আমজাদ হোসেনের স্ত্রী নার্গিস আক্তার বলেন, ‘বাড়ির সামনের জায়গাটুকু পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল, ময়লা ফেলতাম। গরু-ছাগল বেঁধে রাখতাম, প্রসাব-পায়খানা করত অনেকেই। দুর্গন্ধ ছড়াত।
‘এখন এ জায়গায় দেড় শতকে অনেক ধরনোর শাক-সবজির চাষ করছি। টাটকা সবজি সংগ্রহ করে খেতে পারছি। বাগানটি করে অনেক উপকৃত হয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেড় শতক জায়গা এখন আমার কাছে অনেক বড় সম্পদ মনে হচ্ছে। লাউ, বেগুন, শিম, বরবটি, পেঁপে, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলা, কায়তা, পাটশাক, লালশাক ও সবুজ শাক চাষ করছি।’
বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জায়গায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান গড়ে তুলেছেন সরকারপাড়ার আফতাব উদ্দিনের স্ত্রী জোহরা বেগম।
তিনি বলেন, ‘এখন আর আমাদের বাজার থেকে শাক-সবিজ কিনতে হয় না। নিজেদের বাগানে শাক-সবজি জৈব সার দিয়ে চাষ করছি। এতে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করছি না। মুরগির বিষ্ঠা, মাছের পানি, উচ্ছিষ্ট সার হিসেবে ব্যবহার করছি।
‘শুধু আমরা খাই তা কিন্তু নয়, অনেকে কিনে নিয়ে যান সবজি। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছি আমরা, এটাই বড় বিষয়।’
কোরানীপাড়া এলাকার দিনমজুর মোতালেব হোসেন। তিনিও বাড়ির পাশে দেড় শতক জায়গাজুড়ে গড়ে তুলেছেন সবজির বাগান। বলেন, ‘আমি চিন্তাও করিনি এতটুকু জায়গায় এত ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এটি সম্ভব হয়েছে, বিশেষ করে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোমিনুর মোস্তফা জামানের উদ্যোগেই এটি সম্ভব হয়েছে।’
‘তিনি আমাদের বীজ দিয়েছেন, কোথায় কী বীজ দিতে হবে, কিভাবে জাংলা দিতে হবে, সব শিখিয়ে দিয়েছেন। যার ফলে এ ধরনের বাগান করা সম্ভব হয়েছে।’
রোববার ব্রহ্মোত্তর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ৩৫টি বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠা পাড়াটি এখন সবজি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে সবজি গ্রামের লোকেশন।
আর এলাকার মানুষ এখন আর সরকারপাড়া, কোরানীপাড়া কিংবা কুতুপাড়ার মানুষ হিসেবে নন, পুষ্টি গ্রামের মানুষ হিসেবে পরিচিত।
এলাকার বাসিন্দা পোশাক কারখানার শ্রমিক খাদিজাতুল জান্নাত বলেন, ‘রাস্তা দিয়ে হাঁটলে এখন আর প্রসাব, পায়খানা বা আবর্জনা চোখে পড়ে না। লাউ, শিম, বরবটি, পেঁপে, বেগুনের মতো সবজিগুলোতে এখন চোখ জুড়িয়ে যায়।
‘আমিও পারিবারিক পুষ্টি বাগান করতে যোগাযোগ করেছি ওই কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে। এ বাগানের উপকারিতা চোখের সামনে দেখছি।’
ব্রহ্মোত্তর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোমিনুর মোস্তফা জামান বলেন, ‘চলতি বছরের শুরু থেকে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন শুরু হয়। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণ, বীজ ও সার দিয়ে পরিকল্পনামাফিক এ বাগান তৈরি করা হয়। এর সুফল পাচ্ছেন বাগান মালিক ও এলাকার বাসিন্দারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাগানের মালিকরা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ শাক-সবজি গ্রহণ করতে পারছেন, উৎপাদনে মনোনিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং সংসারের কাজের ফাঁকে তারা কৃষিতে সময় দিতে পারছেন। এটি কৃষি বিভাগের একটি সফলতা।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহিনা বেগম জানান, ‘উপজেলায় ৬০০টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে ২৮৬টি বাগান তৈরি হয়েছে। কামার পুকুর ইউনিয়নের ব্রহ্মোত্তরপাড়ায় ৩৫টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। এলাকাটি এখন পুষ্টি গ্রাম হিসেবেই পরিচিত।
‘ওই এলাকার বাসিন্দারা এখন নিরাপদ সবজি গ্রহণ করছেন। সরকারিভাবে বীজ, সার ও চারা দেয়া হচ্ছে। শাক-সবজির পাশাপাশি কমলা, পেয়ারা, মাল্টা ও লেবুও উৎপাদন করছেন বাগানিরা।’
এ বিষয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রাবেয়া আলীম বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও যাতে খালি না থাকে। কৃষি বিভাগও সে চেষ্টাই করে যাচ্ছে। সেই আলোকে সৈয়দপুরে বাড়ির আঙিনায় পুষ্টি বাগান তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘কামার পুকুর ইউনিয়নের ব্রহ্মোত্তর এলাকার পুষ্টি বাগান পরিদর্শন করেছি। খুব ভালো লেগেছে সবজি বাগান দেখে। শুধু সৈয়দপুর নয়, পুরো নীলফামারী জেলার প্রতিটি বাড়িতে এ ধরনের বাগান গড়ে তুলতে আমরা সহযোগিতা করব।’