শিক্ষার্থীদের দেয়া চার দফা দাবির বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করে সংবাদ সম্মেলন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের বেঁধে দেয়া চার দিনের আলটিমেটামের মাঝেই দাবিগুলোর সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভাকক্ষে চার দফা দবি ও চলমান ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান।
এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার, উপ-উপাচার্য বেনু কুমার দে এবং প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের চারটি দাবির মধ্যে প্রথমটি ছিল- ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিতে হবে। মেয়েদের হল থেকে বের হওয়া বা ঢোকার এবং মেডিক্যালে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সময়সীমা তুলে নেয়ার নির্দেশনা দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল ভেঙে নতুন কার্যকরী সেল গঠন করতে হবে। বিচার নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সময়সীমা থাকবে এক মাস এবং তা করতে ব্যর্থ হলে সেল স্বয়ং নিজের শাস্তির বিধান করবে।
তৃতীয়ত, যৌন নিপীড়ন সেলে চলমান অভিযোগগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে।
চতুর্থত, আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন।
এসব দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ১ নম্বর দাবির প্রেক্ষিতে জানাচ্ছি যে, ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় প্রশাসনের গৃহীত ত্বরিত ব্যবস্থা সর্বমহলে প্রশংসিত হলেও অন্য একটি সিদ্ধান্তের খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ছাত্রীদের রাত ১০টার মধ্যে হলে প্রবেশের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। চবি প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না থাকলেও এই সিদ্ধান্ত ২০ জুলাই থেকে কার্যকরের কথা রটে যায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আনুমানিক দুই শতাধিক ছাত্রী ২০ জুলাই রাতে নিজ নিজ হল থেকে বের হয়ে ভিসির বাংলোর সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। অথচ চবি প্রশাসন এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আদৌ নেয়নি বা অফিশিয়াল নির্দেশ প্রদান করেনি।’
২ নম্বর দাবির বিষয়ে রেজিস্ট্রার জানান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা, ২০০৮-এর ৫.২ ধারা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র’ আছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনার ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনার জন্য একটি অভিযোগ কমিটিও আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অ্যাক্ট অনুযায়ী গঠন করা আছে একটি ডিসিপ্লিনারি কমিটিও।
শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই যৌন নিপীড়ন সেল ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র’ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগ কমিটিও পুনর্গঠন করা হয়েছে।
৩ নম্বর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রেজিস্ট্রার বলেন, ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র’র কাছে তিনটি অভিযোগ গত ২১ ও ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।’
এ ছাড়া ৪ নম্বর দাবির বিষয়ে রেজিস্ট্রার জানান, যে রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রী হেনস্তার ঘটনা ঘটে, সে রাতেই চবি প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে সব হলের প্রভোস্ট, রেজিস্ট্রার, ছাত্রছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনা পরিচালক এবং প্রক্টরিয়াল বডিকে নিয়ে জরুরি সভায় মিলিত হয়। এ বিষয়ে প্রশাসন দ্রুত প্রতিবেদন দেয়ার শর্তসাপেক্ষে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করেছে।
রেজিস্ট্রার বলেন, ‘আমরা যেকোনো ধরনের যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ ঘোষণা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
তিনি জানান, ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিয়েছিল চার কার্যদিবসের মধ্যে এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। তদন্ত কমিটি ভুক্তভোগী ও তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন পেশ করেছে। প্রশাসনের ত্বরিত পদক্ষেপের কারণে তদন্ত কমিটি গঠনের এক কার্যদিবসের মধ্যেই অভিযুক্ত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অ্যাক্ট অনুযায়ী গঠিত ‘ডিসিপ্লিনারি কমিটি’ কর্তৃক এ ঘটনায় জড়িত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে।
এ ছাড়া বহিরাগত অন্য প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের তাদের নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও জানান রেজিস্ট্রার।
চবি উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য। তাই আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে জানাতে চাই, বর্তমান প্রশাসন এই ক্যাম্পাসে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।’
তিনি জানান, ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাস্তা ও স্থাপনায় পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও নিরাপত্তা প্রহরীদের ডিউটির পালাক্রম বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রী হেনস্তার মতো এ অনভিপ্রেত ঘটনার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে চবি প্রশাসন নজির স্থাপন করেছে। ভবিষ্যতে এ-জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সজাগ থাকবে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।’