মাসখানেক আগেও বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা। প্লাবিত হয় রংপুর ও লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর নিম্নাঞ্চল। সেই ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা। অথৈই পানিতে ডুবে থাকা ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতির ছাপ এখনও আছে পাড়ায় পাড়ায়।
সেই থইথই পানির দৃশ্য এক মাসেই বদলে গেছে। পানির অভাবে এখন কুড়িগ্রামসহ রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষ আমনের আবাদ করতে পারছেন না। আমন ধান রোপণের সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন জেলার কয়েক লাখ কৃষক।
বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আষাঢ় পেরিয়ে এখন চলছে শ্রাবণ। এরপর এ অঞ্চলে চলছে তীব্র দাবদাহ। খরা কাটাতে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়া, মোনাজাতসহ ব্যাঙের বিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
ফেটে যাওয়া আমনের জমিতে সেচ দিচ্ছে দুই শিশু। ছবি: নিউজবাংলা
শনিবার জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৪ সপ্তাহের প্রখর রোদে ও খরায় ফসলের জমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এরই মধ্যে রোপণ করা আমনের চারা পানির অভাবে লালচে হয়ে মরে যেতে শুরু করেছে। বিকল্প উপায়ে কৃষকরা পানি দিয়ে ধানের চারা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
এদিকে পানির অভাবে সঠিক সময়ে চারা রোপণ করতে না পারায় বীজতলাতেই সেগুলো বাড়ছে। এতে আমন ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। একই সঙ্গে বৃষ্টি না থাকায় আমন চাষে খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাদের।
তবে কৃষি বিভাগ থেকে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সেচযন্ত্রের মাধ্যমে চারা রোপণের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনেক কৃষক।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিস জানিয়েছে, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ৬ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। জুলাই মাস শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত আমন রোপণ করা হয়েছে মাত্র ৩৯ হাজার ২৩৯ হেক্টর জমিতে।
কৃষকের দুশ্চিন্তা
কুড়িগ্রামের রৌমারী সদর উপজেলার কৃষক রহমত আলী বলেন, ‘যখন পানি দরকার তখন বৃষ্টি হয় না, যখন দরকার নেই তখন পানিতে তলিয়ে যায় সবকিছু। বানের পানিতে ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে। ফসল নষ্ট হয়েছে। আর এখন জমিতে সেচ দেয়া লাগছে।’
নাগেশ্বরী উপজেলার বালাটারী গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, ‘উঁচু জমিতে শ্যালো মেশিন বা মটারের পানি উঠানো যায় না, কিন্তু বৃষ্টির পানি জমে থাকে। এবার বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ মাসে কিছু বৃষ্টি হলেও পুরো আষাঢ় মাসে কোনো বৃষ্টি হয়নি। প্রচণ্ড গরম আর খরায় মাটি ফেটে ফেটে যাচ্ছে। অথচ অন্য বছরগুলোতে এ সময় অর্ধেক জমিতে চারা লাগানো হয়ে যায়।’
একই গ্রামের আনসারুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি না হওয়ায় ধানের বিচন মরে যাচ্ছে। বিচন বাঁচাইতে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি দিতে হচ্ছে। এদিকে রোদে মাটি শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে। এমন খরা আবহাওয়া থাকলে আমন ধান হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
বিকল্প উপায়ে ক্ষেতে দেয়া হচ্ছে পানি। ছবি: নিউজবাংলা
তিন বিঘা জমিতে আমনের চাষ করেছেন কাউনিয়ার বিন্যাটারী গ্রামের কৃষক মফিজুল ইসলাম। চারা লাগানোর পর থেকে ১০ দিনে ৪ বার সেচ দিতে হয়েছে ক্ষেতে। এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে খরচ হচ্ছে ৬০০ টাকা। এ ছাড়া সার ও কীটনাশকের দামও বেড়েছে। আমনের আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
মমিনপুর ইউনিয়নের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘দেড় মাস থেকে বৃষ্টি নাই। রোদে মাঠ-ঘাট খাঁ খাঁ করছে। দুদিন পরপর আমনের ক্ষেতে পানি দিচ্ছি। এভাবে আবাদ করলে খরচ বেড়ে যাবে, পোষানো যাবে না। তখন মরণ ছাড়া উপায় নাই।’
তাই সার ও কীটনাশকের দাম কমানোসহ আর বেশিসংখ্যক ডিপটিউবওয়েল বসালে অনাবৃষ্টিতেও কৃষকরা কিছুটা উপকৃত হতো বলে জানান কৃষক আফজাল হোসেন।
রংপুর অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, কয়েক দিন ধরেই এ অঞ্চলের তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলবায়ু দুই সপ্তাহ ধরে চলছে এ অবস্থা। চলতি সপ্তাহে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যা বলছে
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অনাবৃষ্টির কারণে আমন ধান রোপণ কিছুটা ব্যাহত হলেও কৃষকরা যন্ত্রের মাধ্যমে সেচ দিয়ে ধান রোপণ শুরু করেছেন।
‘মাঠপর্যায়ের অফিসারদের মাধ্যমে আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি, উঁচু জমিতে সেচ দিয়ে আমন চাষ করতে। এতে খরচ একটু বেশি হয়। প্রাকৃতিক কারণেই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়েছি কৃষকরা শতভাগ প্রস্তুতি নিয়ে আছেন। বৃষ্টি হলে আমন লাগানোর ধুম পড়ে যাবে। এতে আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে, আশা করছি।’