চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি ও সাবেক সহসভাপতি প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিতে বাধা দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন হেনস্তার অভিযোগ করা ছাত্রী।
ওই ছাত্রীর দাবি, হেনস্তার ঘটনার পরদিন ১৮ জুলাই তিনি প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করতে চাইছিলেন। সে সময় তাকে বাধা দেন চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও তার অনুসারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সুমন নাছির।
ছাত্রীর অভিযোগ, ছাত্রলীগের দুই নেতা নিজেদের মধ্যে মীমাংসার কথা বলে তাকে অভিযোগ করতে মানা করেন।
লিখিত অভিযোগে কী জানালেন ছাত্রী
চবি প্রক্টরের কাছে গত ১৯ জুলাই লিখিত অভিযোগ করেন ওই ছাত্রী। এতে তিনি জানান, ১৭ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি ও তার বন্ধু প্রীতিলতা হলে ফেরার সময় কাছের একটি সড়কে কয়েক যুবক তাদের পথরোধ করেন। তাদের মারধর করে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনে ঝোঁপে নিয়ে যান যুবকরা।
ছাত্রী আরও জানান, তাকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ভিডিও করা হয় এবং সেই ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান যুবকরা। তার বন্ধু এর প্রতিবাদ করলে তার ওপরও নির্যাতন করা হয়। পরে যুবকরা দুজনের মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনতাই করে পালিয়ে যান।
ছাত্রীর বন্ধুর ভাষ্য
হেনস্তার অভিযোগ করা ছাত্রীর বন্ধু ঘটনার পরদিনও তার সঙ্গেই ছিলেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনায় প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করতে চাইলে (চবি ছাত্রলীগ) সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বাধা দেন। তিনি আমার বান্ধবীকে সেখানে যেতে মানা করেন। নিজেরাই অভিযুক্তদের খুঁজে বের করবেন বলে জানান।’
ছাত্রীর বন্ধু একই অভিযোগ করেন চবি ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সুমন নাছিরের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ঘটনার রাতে জিরো পয়েন্ট এলাকায় সুমন নাছিরকে বিষয়টি জানান। সুমন বিষয়টি দেখবেন বললেও পরদিন তার বান্ধবীকে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করতে নিষেধ করেন।
ঘটনার বিষয়ে ছাত্রীর বন্ধু নিউজবাংলাকে বলেন, “পাঁচজন অপরিচিত ব্যক্তি আমাদের হেনস্তা করেন। এর মধ্যে একজন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন। তারা মোবাইল নেয়ার পর বলেন, ‘এখন আমাদের কী দিবা?’ একটি মেয়েকে ওই অবস্থায় দেখে আমি ওদের বলেছিলাম, ‘কী লাগবে?’ ওরা হাসছিল। ছেলেগুলোর মুখে মাস্ক পরা ছিল।
“বিবস্ত্র করে ছবি তোলার বিষয়টি মিথ্যা নয়। তারা আমাদের মারধর করেছে অনেক। এরপর টাকা-মোবাইল ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এরপর রাতে অনেকক্ষণ আমরা তাদের খোঁজাখুঁজি করি।”
এ যুবক আরও বলেন, ‘সভাপতি রেজাউল হক আমার বান্ধবীকে ছোট বোন বলে পরিচয় দেন। আমার বান্ধবী পলিটিক্যাল সিটে ওঠার কারণে রুবেলের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল, তবে সে কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যেত না।
‘ঘটনার পরই সুমন নাছিরকে সামনে পেয়ে প্রথমে বিষয়টি জানানো হয়। এরপর রুবেলকে জানালে তিনি সহকারী প্রক্টরকে জানান। পরে আমার বান্ধবীকে হলে পাঠানো হয়।’
ওই ছাত্রীর বরাতে তার বন্ধু বলেন, “প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দিতে নিষেধ করে পরদিন সকালে সুমন ব্যাপারটি দেখার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাপারটা এখানে ধামাচাপা হয়ে যাবে। আমরা অভিযুক্তদের খুঁজে বের বের করব। তাদের শাস্তি দেব।
“রুবেলও আমার বান্ধবীকে অভিযোগ করতে নিষেধ করে বলেন, ‘তুমি, আমি ও সুমন তিনজন যাব। আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কাছে নিয়ে যাব। চিনতে পারলে তাদের আমরা শাস্তি দেব। কোথাও যেন কোনো অভিযোগ দেয়া না হয়।’”
লিখিত অভিযোগ জমা দেয়ার সময় রুবেল সেখানে উপস্থিত হন বলে জানান ওই ছাত্রীর সঙ্গে যাওয়া একাধিক বন্ধু। অভিযোগ জমা না দেয়ার বিষয়ে রুবেল ছাত্রীকে নানাভাবে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেন বলেও জানান তারা।
অভিযোগ অস্বীকার রুবেলের
ছাত্রীকে অভিযোগ দিতে বাধা দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রুবেল। তিনি একে ‘অপরাজনীতি’ বলে আখ্যায়িত করেন।
রুবেল বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের বাধা দিইনি। আমি তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি, (অভিযোগ করতে) উৎসাহ দিয়েছি। আমি অপরাজনীতির শিকার হচ্ছি।’
মীমাংসা করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি যে, আসামি যে-ই হোক, সবাই মিলে প্রশাসনের সহযোগিতায় খুঁজে বের করব; ও যেন টেনশন না করে। অভিযোগ দিতে কোনোভাবেই নিষেধ করিনি। ওই ছাত্রী ট্রমার মধ্যে ছিল, আমরা সান্ত্বনা দিয়েছি।’
রুবেল আরও বলেন, ‘আমার ছোট বোন হেনস্তার শিকার হয়েছে। এর বিচার চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হচ্ছি। আমি তাকে বলেছি, তুমি অভিযোগ দাও। চিন্তা করো না, আমরা অভিযুক্তদের খুঁজে বের করব। এখানে অন্য একটা সংগঠন অপরাজনীতি করছে।
‘আমার কাছে যখন ঘটনা বলার সময় তাকে সন্দেহভাজন কয়েকজনের ছবি দেখাই, সে কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি। বিষয়টি আমাকে গোপন রাখতে বলেছিল। সে সহযোগিতা চেয়েছে। আমি রাতেই প্রক্টরকে ফোন করি।’
প্রক্টর অফিসে উপস্থিত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বিকেলে আমার কাজে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি তারাও উপস্থিত। আমি সেখানে কোনো প্রভাব বিস্তার করিনি।
‘ওই ছাত্রী যখনই কোনো সমস্যায় পড়ত, আমাকে ফোন করত। আমিও আমার মতো করে হেল্প করতাম। সেদিনও আমি তাকে হেল্প করতে এগিয়ে যাই। এ ঘটনায় অভিযোগ দিতে চাইলে আমি ওই মেয়েকে বলেছি, তোমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়, সেটি করো।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চবি ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সুমন নাছিরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে কল দেয়া হয়। সাড়া না পেয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। তাতেও সাড়া মেলেনি বলে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
রুবেলকে শোকজ
গত ২০ জুলাই শৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলকে কারণ দর্শাতে বলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, তবে কী কারণে এই শোকজ, সেটি স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
এ বিষয়ে সভাপতি রুবেল বলেন, ‘কমিটি সংক্রান্ত কারণে শোকজ করা হয়েছে।’