কুমিল্লায় গত বছর দুর্গাপূজা চলাকালে মণ্ডপ থেকে কোরআন শরিফ উদ্ধারের পর নোয়াখালীতে ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। এসব ঘটনায় জেলায় ৩২টি মামলা হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) দুটি ও কোম্পানীগঞ্জ থানার একটির অভিযোগপত্র আদালতে জমা হয়েছে। এখনও ২৯ মামলার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ১১টি ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ১১টি মামলার মধ্যে কোনোটির তদন্ত শেষ হয়নি। এ কারণে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারেনি এ দুই সংস্থা।
প্রেক্ষাপট
কুমিল্লার ঘটনার জেরে ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর জুমার নামাজ শেষে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী বাজারের বিভিন্ন মসজিদ থেকে কয়েক হাজার মুসল্লি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। একপর্যায়ে প্রধান সড়কের উত্তর পাশের শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার, রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারসহ হিন্দু ধর্মালবম্বীদের দোকানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
মিছিলকারীরা কলেজ রোডে ঢুকে আশপাশের দোকান এবং রামঠাকুর আশ্রম, রাধা মাধব জিওর মন্দির, ইসকন মন্দিরসহ প্রায় ১২টি মন্দির ও মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
কলেজ রোড়ের বিজয়া দশমী পূজামণ্ডপে হামলার সময় ৩২ বছর বয়সী যতন সাহা নামে একজনের মৃত্যু হয়। পরদিন সকালে ইসকন মন্দিরের পুকুরে ২০ বছরের প্রান্ত চন্দ্র দাস নামে আরেকজনের মরদেহ ভেসে ওঠে।
ওই হামলার ঘটনায় বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান সিকদার, চার পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন।
১৩ ও ১৪ অক্টোবর নোয়াখালীর হাতিয়া, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সুধারাম ও সেনবাগ উপজেলায় মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
কী অবস্থা মামলাগুলোর
জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ওই সময়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে হামলার ঘটনায় ৩২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বেগমগঞ্জ থানায় ১৫, হাতিয়া থানায় ১০, সেনবাগ থানায় ১, সোনাইমুড়ী থানায় ১, চাটখিল থানায় ১, কোম্পানীগঞ্জ থানায় ২, কবিরহাট থানায় ১ ও সুধারাম থানায় ১টি মামলা হয়।
এসব মামলায় ১ হাজার ৬ জনকে আসামি করা হয়। অজ্ঞাতপরিচায় আসামি রয়েছে ৯ হাজার ৯৫৬ জন। মামলায় এজাহারভুক্ত ১২৫, সন্দেহভাজন ১৯৯ জনসহ ৩২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ জানায়, ৩২টি মামলার মধ্যে পিবিআই নোয়াখালী ১১টি, সিআইডি নোয়াখালী ১১টি এবং জেলা পুলিশ নোয়াখালী ১০টি মামলা তদন্ত করছে। এর মধ্যে জেলা ডিবি দুটি এবং কোম্পানীগঞ্জ থানা একটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
নোয়াখালীতে হামলা মামলার বিষয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট পাপ্পু সাহা বলেন, ‘বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার যারা কারাগারে ছিলেন, তাদের অধিকাংশ জামিনে বের হয়ে গেছেন। সহিংসতার শিকার ব্যক্তিরা এখনও আতঙ্কে আছেন। আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যেন চার্জশিট দেয়।
‘কোনো নিরপরাধী লোকজনকে যেন মামলায় জড়ানো না হয়। প্রকৃত অপরাধীরা যদি বিচারের মাধ্যমে শাস্তি পায়, তাহলে আতঙ্ক কাটবে বলে মনে করি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা হাবিবুর রাসুল মামুন বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবরে কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নোয়াখালীর চৌমুহনী বাজারের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মন্দির, মণ্ডপ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ এবং সম্পদ লুণ্ঠন হয়েছে। দুজনের মৃত্যুও হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি, মামলাগুলোতে প্রকৃত জড়িতদের বাইরেও শুধু দলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য ভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাই মামলাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব মামলায় অনেক অজ্ঞাতপরিচয় আসামি রয়েছে। ফলে সব মামলা কবে শেষ হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তদন্ত কবে নাগাদ শেষ হবে এবং বিচার কবে শুরু হবে, সেটিই এখন মৌলিক প্রশ্ন।’
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান মুন্সি বলেন, ‘হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে আমরা ১১টি মামলা তদন্ত করছি। এখনও কোনোটির অভিযোগপত্র জমা হয়নি।’
সিআইডির পুলিশ সুপার বশির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কাছে একটি হত্যা মামলাসহ ১১টি মামলা তদন্তাধীন। তার মধ্যে তিনটি মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পথে। শিগগিরই এই তিনটি মামলার চার্জশিট জমা দেয়া হবে। বাকি আটটি মামলা তদন্তাধীন।’
নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দীপক জ্যোতি খীসা বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় জেলায় ৩২টি মামলা হয়েছে। পিবিআই ১১টি, সিআইডি ১১টি ও জেলা পুলিশ ১০টি মামলার তদন্ত করছে। এর মধ্যে জেলা পুলিশ তিনটি মামলার চার্জশিট দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হামলা, ভাঙচুরের মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বিভিন্ন লোকজনের নাম এসেছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আসামি করা বা হয়রানি করার অভিযোগ সঠিক নয়।’