প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার মামলায় পিরোজপুরের এহসান গ্রুপের সদস্য কুয়াকাটা হুজুর নামে পরিচিত হাফিজুর রহমান আদালতে হজিরা দিয়েছেন।
হাইকোর্ট থেকে দেয়া ৪২ দিনের আগাম জামিন শেষে মঙ্গলবার পিরোজপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হাজিরা দেন তিনি।
বিচারক সাদেকুর রহমান শুনানি না করে আগামী ২৪ জুলাই তারিখ রাখেন।
গত ২১ জুলাই হাইকোর্ট এই মামলায কুয়াটাকা হুজুরকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দেয়। এর মধ্যে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খান মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘এহসান গ্রুপের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এর ঘটনায় করা মামলার আসামি হাফিজুর রহমান কুয়াকাটা হুজুরের নামে মোট চারটি মামলা রয়েছে।’
প্রতারনা ও জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের থেকে তোলা টাকা হাতিয়ে নেয়া অভিযোগে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগিব আহসান ও তার ভাইরা এখন কারাগারে। তাদের স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জেলা প্রশাসকের আওতায় রাখার নির্দেশও দিয়েছে আদালত।
শরিয়তসম্মত বিনিয়োগের প্রলোভনে আত্মসাৎ
‘শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’ কেমন হবে, তার প্রচার চালিয়ে হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
ব্যবসার ফাঁদ পাতা হয়েছে ওয়াজ মাহফিলসহ ধর্মীয় মজলিসে, ব্যবহার করা হয়েছে ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্রদের। তারা শরিয়তসম্মত বিনিয়োগের কথা শুনে অকাতরে টাকা ঢেলেছেন, এরপর ঠকেছেন।
পিরোজপুরে 'এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে এভাবে টাকা তোলার অভিযোগে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন এই গ্রুপের প্রধান মুফতি রাগীব আহসান।
গত সেপ্টেম্বরে র্যাব তাকে গ্রেপ্তারের পর জানানো হয়, ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ১৯৯৬ থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে ধর্মীয় আইনে পড়াশোনা শেষ করে মুফতি হন।
এরপর পিরোজপুরে একটি মাদ্রাসার মসজিদে ইমামের চাকরি শুরু করেন। ২০০৬-২০০৭ সালে ইমামতির পাশাপাশি 'এহসান এস মাল্টিপারপাস' নামে এমএলএম কোম্পানিতে মাসে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি নেন। ২০০৮ সালে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন 'এহসান রিয়েল এস্টেট' নামে এমএলএম কোম্পানি।
এই কোম্পানির মাধ্যমে আনুমানিক ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে ১৫টির অধিক মামলা রয়েছে এবং তিনি এর আগে একবার জেলও খেটেছেন।
ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে টাকা উত্তোলন
রাগীবকে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে গত ২১ সেপ্টেম্বর র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীব মূলত ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে অপব্যবহার করে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করেন। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, ইমাম ও অন্যদের টার্গেট করেই তিনি কাজ করতেন।
তিনি 'শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ'-এর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন। ওয়াজ মাহফিলেও ব্যবসায়িক প্রচার-প্রচারণা চালানো হতো।
তিনি লাখ টাকার বিনিয়োগে মাসে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভন দেখান। এভাবে ২০০৮ সালেই ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করতে সমর্থ হন। এরপর গ্রাহকের সংখ্যা একপর্যায়ে ছাড়িয়ে যায় লক্ষাধিক।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, রাগীব হাউজিং ল্যান্ড প্রজেক্ট, দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সাধারণ গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘অনেকেই পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এ ছাড়া অনেকেই ভয়ভীতি, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হতেন বলে ভুক্তভোগীরা জানায়।’
তিনি কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন এমন প্রশ্নে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘বিভিন্ন ভুক্তভোগীর তথ্য, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আনুমানিক তিনি ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।’