সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার যে ঘোষণা, উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রংপুর ও রাজশাহীর ১৬ জেলায় তা মানা হচ্ছে না। বিদ্যুৎ যাচ্ছে বারবার। কখনও আধা ঘণ্টা, কখনও এক ঘণ্টা, কখনও তার চেয়ে বেশি সময় থাকছে লোডশেডিং।
তীব্র গরমে বিদ্যুতের বারবার যাওয়া-আসায় জনজীবন যেমন অতিষ্ঠ, তেমনি কারখানায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা দিচ্ছে অচলাবস্থা।
বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাগুলো বলছে, তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে না। তাই কথা রাখা যাচ্ছে না। গ্রাহকদের এসএমএস পাঠিয়ে দুঃখও প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার তার উৎপাদনক্ষমতার একটি বড় অংশ বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে চাইছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে হঠাৎ করে বিদ্যুতের যাওয়া-আসা শুরু হলে জানানো হয়, ঈদের পর থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সূচি করে দেয়া হবে।
সোমবার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংবাদ সম্মেলন করে জানান, সারা দেশে আপাতত দিনে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকবে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে লোডশেডিং হবে দিনে দুই ঘণ্টা।
এর পর থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো তার আওতাধীন এলাকাগুলোর মধ্যে কোনটিতে কখন বিদ্যুৎ বন্ধ রাখবে সেই সূচি অনলাইনে আপলোড করতে থাকে।
দিনে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধের সিদ্ধান্তে মানুষ খুব একটা অসন্তুষ্ট হয়েছে, এটা বলা যাবে না। কিন্তু কথা রাখতে না পারা উত্তরে তৈরি করছে অসন্তোষ।
বারবার বিদ্যুৎ বন্ধে এসএমএসে দুঃখ প্রকাশ
এ বছর রাজশাহী অঞ্চলে আষাঢ়ে নেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি। প্রচণ্ড গরমে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে জীবন হয়ে পড়েছে দুঃসহ।
মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রতি এলাকাতেই অন্তত চারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটেছে। একবার গেলে অন্তত এক ঘণ্টা আর আসছে না।
এই জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি বা নেসকো বলছে, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কথা রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
ভোরেই যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায় সেসব এলাকার মানুষ ধারণা করেন, এক ঘণ্টা লোডশেডিং যেহেতু হয়েই গেল, সারা দিন বুঝি আর যাবে না।
কুমারপাড়া এলাকার প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলামও ভেবেছিলেন সকাল সকাল আপদ দূর হলো। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে হতাশ হতে হলো।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আজ তো বলতে গেলে ছুটিই কাটাচ্ছি সারা দিন। দুই ঘণ্টা কাজ করছি তো এক ঘণ্টা বন্ধ। এতে ক্ষতি হচ্ছে, সঙ্গে বিরক্তিও তৈরি হচ্ছে।’
মালদা কলোনি এলাকার ব্যবসায়ী রাসেদুর রহমান বলেন, ‘সকাল থেকে খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। ব্যবসার তো খারাপ অবস্থা। গরমে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে গেছে।’
এই অবস্থায় নেসকোর পক্ষ থেকে মঙ্গলবার গ্রাহকদের কাছে এসএমএস পাঠিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অপ্রতুল। ফলে নেসকোর আওতাধীন এলাকায় অনিচ্ছাকৃত লোডশেডিং হচ্ছে।
রাজশাহীতে ঘাটতি ২৭ শতাংশ
সরকারি হিসাবে দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা ও উৎপাদনে ফারাক ১৫ শতাংশের বেশি। তবে রাজশাহী অঞ্চলে সরবরাহ কম ২৭ শতাংশের মতো।
নেসকোর রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৪৩০ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ পাওয়া গেছে ৩১২ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করতে হয়েছে ১১৮ মেগাওয়াট।
তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার কথা থাকলেও আমরা সেই কথা রাখতে পারছি না।’
আবহাওয়াও বিরূপ
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, প্রতি বছর আষাঢ় মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়, এবার তা হয়নি।
রাজশাহীতে গত বছর আষাঢ়ে বৃষ্টি হয় ২৫ দিন, সব মিলিয়ে ৩৫৪ মিলিমিটার। চলতি বছর আষাঢ়ের এক মাসে বৃষ্টি হয়েছে ৮ দিন, বৃষ্টির পরিমাণ ৩৯ দশমিক ০২ মিলিমিটার।
এই ৮ দিনের মধ্যে গত ১৮ জুন এক দিনেই হয়েছে ২০ দশমিক ৯ মিলিমিটার। ২০ জুন হয় আরও ৯ দশমিক ১ মিলিমিটার। এরপর বাকি দিনগুলোতে খুবই কম বৃষ্টি হয়েছে।
রাজশাহীর তাপমাত্রা থাকছে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রেজোয়ানুল হক বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে কোনো বৃষ্টি হয়নি। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। আর ভারি বৃষ্টি না হলে তাপমাত্রা কমবে না।’
রংপুরে সরবরাহ চাহিদার অর্ধেক
রাজশাহীতে তাও চাহিদার তিন-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। সর্বউত্তরের বিভাগ রংপুরের পরিস্থিতি আরও খারাপ।
নেসকোর রংপুর কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জেলায় দিনে চাহিদা ১৫০ থেকে ১৫৫ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে ৭৫ মেগাওয়াট।
আর বিভাগের আট জেলায় দিন-রাতে বিদ্যুতের চাহিদা ৯০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৪৫০ মেগাওয়াট।
সরবরাহের এই ঘাটতির কারণে এলাকাভিত্তিক যে লোডশেডিংয়ের সময়সূচি করা হয়েছে তা কাগুজে হয়ে গেছে। দিনে একবার করে লোডশেডিং দেয়ার কথা রাখা যাচ্ছে না।
নেসকোর ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের অধীনে রংপুর শহরেই ২৩টি ফিডার রয়েছে। তাতে প্রতিটি ফিডারে দিনে একবার করে লোডশেডিং দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
কিন্তু সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত চারবার লোডশেডিং হয়েছে। প্রতিটি লোডশেডিং এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
নেসকোর রংপুর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আশরাফুল আলম মণ্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে এলাকাভেদে লোডশেডিংয়ের তালিকা মানা যাচ্ছে না।’
রংপুরের বাইরের নীলফামারী, দিনাজপুর, গাইবান্ধা জেলার ফিডারগুলোতেও একই অবস্থা।
বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় কম্পিউটার, প্রিন্টারসহ নানা ব্যবসায় অচলাবস্থা দেখা গেছে। কাজ শুরু করে অর্ধেক কাজ শেষ না হতেই আবার থামিয়ে দিতে হচ্ছে।
রংপুর প্রেস ক্লাব চত্বরে হোটেল ব্যবসায়ী সাজু মিয়া বলেন, ‘আমরা ফেসবুকে দেখছি বাজার ফিডারে দিনে একবার লোডশেডিং দেবে। কিন্তু ওরা কথা রাখল না। গরমের কারণে কাস্টমার বেশিক্ষণ থাকে না।
‘৯টার দিকে বিদ্যুৎ এলেও আধা ঘণ্টা পর আবার চলে যায়। এক ঘণ্টা পর ফের চলে যায়, আবার আসে এভাবে চারবার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করেছে।’
গুপ্তপাড়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ‘সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চারবার বিদ্যুৎ গেছে। একবার গেলে দেড় ঘণ্টা নাই। এখনও অর্ধেক দিন এবং পুরো রাত বাকি আছে। জানি না কতবার বিদ্যুৎ যাবে।’
তিনি বলেন, ‘ঘোষণা দিল একটা, হচ্ছে আরেকটা। সকাল থেকে বিদ্যুৎ শুধু আসা-যাওয়া করছে। কোনো নিয়মের বালাই নেই।’
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বালাটারী গ্রামের এরশাদ আলী জানান, সকাল থেকে তিনবার বিদ্যুৎ গেছে। যখন গেছে তখন একবার ৪০/৫০ মিনিট করে ছিল। একবার এক ঘণ্টার বেশি পরে এসেছে।
নীলফামারী জেলা শহরের প্রগতি পাড়া এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান লিটু জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুইবার লোডশেডিং হয়। প্রতিবার এক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়।
একই জেলার পঞ্চপুকুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাইদুল ইসলাম জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিন দফায় বিদ্যুৎ ছিল না। প্রতিবারই এক ঘণ্টা স্থায়ী ছিল দুর্ভোগ।
রংপুর চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু বলেন, ‘লোডশেডিং বেশি হলে জেনারেটর দিয়ে হিমাগার চালানো হয়। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে পণ্যের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’