নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে বন্দর উপজেলাকে আলাদা করেছে শীতলক্ষ্যা নদী। প্রতিদিন নৌকা ও ট্রলারে ভোগান্তি নিয়ে নদী পার হন এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ। তাদের এ কষ্টের অবসান হতে যাচ্ছে ডিসেম্বরে। দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষে খুলতে যাচ্ছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু।’
সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘‘আগে এর নাম ছিল ‘তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু’। তবে মাস দুয়েক আগে নতুন ওই নামে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।’’
সড়ক ও সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বন্দরের মদনগঞ্জ ও সদরের সৈয়দপুর এলাকায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১২৩৪ দশমিক ৫০ মিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৮ কোটি টাকা। ছয় লেন বিশিষ্ট এই সেতুর চার লেনে দ্রুতগতির যানবাহন এবং দুই লেনে চলবে রিকশা সাইকেল ভ্যানসহ স্বল্পগতির গাড়ি। সেতুর দুই পাশের রেলিং ঘেষে রয়েছে ফুটপাত।
সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেতু নির্মাণ করা হয়েছে মোট ৩৮টি পিয়ারের ওপর। তার মধ্যে নদীতে রয়েছে ৫টি পিয়ার। ইতোমধ্যে সেতুর ৯২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ‘এখন সেতুর সংযোগ সড়কের কাজ ও জয়েন্ট এবং লাইটিংসহ ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। চলতি মাসেই সেতুর পুরো কাজ শেষ হলে ডিসেম্বরে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।’
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘এ সেতুটি নির্মাণের কারণে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অগ্রগতি যেমন হবে, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের যানবাহনগুলোর চট্টগ্রাম যেতে সময় বাঁচবে দুই ঘণ্টা। পাশাপাশি যানজট কমবে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট মহাসড়কে।’
কী বলছেন এলাকাবাসী
দীর্ঘ দিনের দাবি বাস্তবায়িত হওয়ায় খুশি এলাকার মানুষ।
সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা রিয়া আক্তার বলেন, ‘ব্রিজের কারণে আমাদের যাতায়াত অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমরা চাইলে এখন এদিক দিয়ে কুমিল্লা চাঁদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সহজে যেতে পারব। তবে সবচেয়ে বেশি উপকার হবে রোগীদের।
‘আগে নদী পার হতে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হত। ট্রলারে করে নদী পার হয়ে যেতে হত। সেতু হওয়ার কারণে এই সমস্যা শেষ হচ্ছে। তা ছাড়া এলাকার উন্নয়ন কাজও বেড়েছে। এপার-ওপার দুই পারে বিভিন্ন কারখানা হচ্ছে। এখন চাইলে আমরা যেদিক খুশি গিয়ে কাজ করতে পারব।’
বন্দরের মদনগঞ্জের বাসিন্দা পত্রিকা বিক্রেতা মনির হোসেন বলেন, ‘আমি মুন্সীগঞ্জে পত্রিকা বিক্রি করি। এজন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে সাইকেলে সেখানে যাই। নদী পার হয়ে আমার যেতে অনেক সময় লাগে। সেতুটি হওয়ায় আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে। শুধু আমাদের নয় সারা দেশের মানুষের উপকারে আসবে এই সেতু।
‘পদ্মা সেতু হয়ে মুন্সীগঞ্জ দিয়ে এই সেতু পার হয়ে অনেক জেলায় সড়কে যাতায়াত করা যাবে। সময়ও কম লাগবে। তা ছাড়া মুন্সীগঞ্জের আলুসহ বিভিন্ন কাঁচামাল তাড়াতাড়ি বাজারে যেতে পারবে। পরিবহন খরচ কম লাগবে। এতে আমাদের অনেক উপকার হবে।’
পাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাব্বির আহম্মেদ বলেন, ‘ব্রিজ হওয়ার কারণে আমরা অনেক খুশি। এখন দুই এলাকার মানুষের মধ্যে যোগাযাগ স্থাপন হবে। আগে রাতের বেলা নানা বিপদে আমাদের নদী পার হতে সমস্যা হত। এখন আর তা হবে না। সেতু চালু হলে সব সময় গাড়ি চলাচল করবে।’
মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা জুবায়ের আহম্মেদ বলেন, ‘আমি ফটোগ্রাফার। বিভিন্ন এলাকায় ছবি তুলতে যাই। আমাদের এলাকা দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলোতে যেতে হলে অনেক কষ্ট হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কের সাইনবোর্ড অথবা শিমরাইল যেতে হয়। সেখান থেকে পরে অন্য গাড়িতে যেতে হয়।
‘শীতলক্ষ্যা সেতু হয়েছে। এখন আমাদের মুন্সীগঞ্জবাসীর জন্য অনেক সুবিধা হবে। আমরা এই সেতু ব্যবহার করে সহজে যাতায়াত করতে পারব। সেতুটি শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, মুন্সীগঞ্জবাসীর জন্যও ভালো হয়েছে। আমরা আনন্দিত।’
বন্দর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এ কে এম মোমিনুল হক বলেন, ‘এই সেতু গ্রামীণ জনপদকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি হবে।’
তিনি জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির কারণে এই অঞ্চলে জমির দাম বেড়েছে। অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে এবং আগামীতে আরও উঠবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘সেতুটিকে ঘিরে মেঘনার বিভিন্ন চর অঞ্চলে অর্থনীতিক জোন তৈরি হচ্ছে। বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় কলকারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। এসব এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়বে।’
বহুমুখী সড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের মোগড়াপাড়া ও মদনপুর এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যানবাহনগুলো এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক হয়ে সরাসরি বন্দরের রস্তায় উঠবে। এই সেতুর রাস্ত থাকবে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর পর্যন্ত। সেখান থেকে শ্রীনগর হয়ে চলে যাওয়া যাবে পদ্মা সেতুর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সুপার এক্সপ্রেসওয়েতে (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক)। তা ছাড়া রাজধানী থেকে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ শহর দিয়ে সেতু পার হওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপদ বিভাগের নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মেহেদী ইকবাল।
তিনি বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরে সেতু খুলে দেয়ার কথা রয়েছে। এজন্য সেতু ও সড়কের কাজ দ্রুত গড়িতে চলছে।’