বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘একাত্তরেও এখানে নিরাপদ ছিলাম, এখন নেই’ 

  •    
  • ১৬ জুলাই, ২০২২ ১৭:৪৫

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী গোপাল সাহা বলেন, ‘হামলাকারীরা কারও দোষ-গুণ খোঁজেনি। হিন্দু হলেই মারধর করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের পরিবার এই গ্রামে ছিল। তখনও নিজেদের নিরাপদ মনে করেছি, তবে এখন আর নিরাপদ মনে করতে পারছি না।’

এক ছাত্রের ফেসবুক থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতমূলক কমেন্ট করার অভিযোগে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামে।

ওই গ্রামের ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু পরিবারের অধিকাংশ সদস্য আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকলেও আস্থা রাখতে পারছেন না তারা।

দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক নারী সদস্য বিউটি রানী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিঘলিয়া গ্রামে প্রায় ৩০০টি পরিবার বসবাস করে। এর মধ্যে ১০৮টি হিন্দু পরিবার রয়েছে গ্রামের সাহাপাড়ায়।

‘হামলার পর হিন্দু পরিবারের নারী-পুরুষরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অধিকাংশ বাড়ির দরজা তালাবদ্ধ রয়েছে। কিছু পরিবারের বয়স্করা বাড়িতে আছেন, তারাও ভীতসন্ত্রস্ত।’

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে একটি ফেসবুকের পোস্টে আকাশ সাহা নামে এক কলেজছাত্রের ফেসবুক আইডি থেকে গত বৃহস্পতিবার বিতর্কিত কমেন্ট করার অভিযোগ ওঠে। এর জেরে শুক্রবার বিকেলে হামলা হয় দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ায়।

হামলাকারীরা গোবিন্দ সাহা ও দিলীপ সাহার বাড়ি, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা অশোক সাহার দোকানসহ ১০টির বেশি বাড়ি-দোকান ভাঙচুর করেন। গোবিন্দ সাহার বাড়িতে আগুনও দেয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি সাহাপাড়া মন্দিরের প্রতিমা, চেয়ার ও সাউন্ড বক্স ভাঙচুর করেন।

হামলার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দু পরিবারগুলোতে

বিউটি রানী অভিযোগ করেন, ‘গ্রামে যখন একের পর এক হিন্দু পুরুষদের মারধর করা হচ্ছিল, তখন পুলিশ ছিল। তারা দূরে থেকে দেখছিল। তারা কাউকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। এ কারণে পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে গ্রামের মানুষ এলাকা ছেড়েছে।’

হামলাকারীদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ছিলেন বলে অভিযোগ করেন বিউটি। তিনি বলেন, ‘তাদের (আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী) উচিত ছিল আমাদের সেইফ করা। অথচ তারা সবাইকে আরও উসকে দিয়েছেন।’

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির মালিক গোবিন্দ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে ছেলেটির কমেন্ট নিয়ে কথা হচ্ছে তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে। তাকে আমরা ভালো করে চিনিও না, তাদের সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্কও নেই।

‘তবু হামলাকারীরা আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। সে কী ফেসবুকে দিয়েছে তাও জানি না। সেও হিন্দু, আমি হিন্দু- শুধু এই কারণে আমার বাড়িতে আগুন দেয়া হলো।’

ঘটনার সময়ের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা যখন আগুন দেয়, তখন আমি ও আমার মা শিপালী রানী সাহা বাড়িতে ছিলাম। ভয়ে আমরা বাড়ির পেছনে বাঁশ বাগানে গিয়ে আশ্রয় নিই। ঘরে আগুন জ্বলতে দেখে মা কান্নাকাটি শুরু করে।’

হামলার সময়ে মরধরের শিকার হন গ্রামের সবচেয়ে বিত্তশালী হিসেবে পরিচিত গোপাল সাহা। স্থানীয় দিঘলিয়া বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসা রয়েছে তার।

গোপাল সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২২ বছর ধরে আমি বাজারে ব্যবসা করি। দিঘলিয়া গ্রামসহ আশপাশের সব গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। সবাই ভালো জানে। অথচ কোনো কারণ ছাড়া, শুধু হিন্দু হওয়ার জন্য তারা আমাকে মারধর করেছে। অভিযুক্ত ছেলেটির বাড়ি, আমার বাড়ি থেকে সামান্য দূরে, এটা কি আমার দোষ?’

তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা কারও দোষ-গুণ খোঁজেনি। হিন্দু হলেই মারধর করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের পরিবার এই গ্রামে ছিল। তখনও নিজেদের নিরাপদ মনে করেছি, তবে এখন আর নিরাপদ মনে করতে পারছি না।’

গোপাল সাহা রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে এই গ্রামে ভালো বাড়ি ঘর তৈরি করেছি। তবে এখন আর থাকার ইচ্ছা নেই। বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাব।’

গ্রামের সব থেকে বয়স্ক ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় শীবনাথ সাহা স্থানীয় রাধা গোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুক্রবার সকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পুলিশ আমাদের গ্রামে আসেন। তারা অভিযুক্ত আকাশ সাহা নামের ওই ছেলে ডেকে নিয়ে আসেন। সেখানে আমাকেও ডাকা হয়।

‘আকাশ সাহা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে তার ফেসবুক আইডিটি হ্যাক হয়ে গেছে। সে ওই কমেন্ট ফেসবুকে করেনি। তখন সবাইকে ডেকে ইউএনও বিষয়টি মিটমাট করে দেন।

‘এরপর বিকেলে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে সাহাপাড়ায় হামলা চালায়। হিন্দুদের বেছে বেছে মারধর করে।’

এলাকাবাসী চরম নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ করলেও প্রশাসনের দাবি, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।

লোহাগড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারান চন্দ্র পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাতেই ওই ছাত্র আকাশ সাহা ও তার বাবা অশোক সাহাকে আমরা থানায় নিয়ে এসেছিলাম। সে (আকাশ) দাবি করছে তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছিল। তবে পুলিশ এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি, হ্যাক হয়েছিল, না-কি সে নিজে এটা করেছে। পুলিশের সাইবার বিভাগ বিষয়টি উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা হিন্দু পরিবারে হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজগর আলী বলেন, ‘ঘটনাস্থলে আমি সরাসরি গিয়েছিলাম এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি।’

হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। যেসব ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে সেগুলো সরকারের পক্ষ থেকে মেরামত করে দেয়া হবে।

‘সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য।’

এ বিভাগের আরো খবর