বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিশা পাগলার ঘরে বস্তাভরা টাকা এলো কোথা থেকে

  •    
  • ১৪ জুলাই, ২০২২ ১৭:৩১

গত ৮ জুলাই নিজ বাড়ির একটি ঘরে বিশা পাগলার মৃত্যু হয়। পরে তার শোবার ঘরে পাওয়া যায় তিনটি বস্তা। মঙ্গলবার এসব বস্তা খোলা হলে বেরিয়ে আসে টাকা, স্বর্ণালংকার ও বিদেশি মুদ্রা। এত টাকা কীভাবে এলো– এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মাঝে।

তাকে এলাকার লোকে ‘ফকির’ বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে চেনে। কিন্তু কুমিল্লা তিতাস উপজেলার বিশা পাগলা মারা যাওয়ার পর তার ঘরে বস্তাভর্তি টাকা পাওয়া যায়, যার পরিমাণ ২ কোটি ৪৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।

বিশা পাগলার স্বজন ও স্থানীয়রা কেউ জানেন না কীভাবে এত টাকা এলো আমির হোসেন ওরফে বিশা পাগলার ঘরে। তাদের ধারণা, ওরসের সময় ভক্তদের থেকে পাওয়া টাকাই জমিয়ে এত টাকার মালিক হয়েছিলেন বিশা।

শুধু টাকা নয়, বিশা পাগলার ঘরে বান্ডিল বান্ডিল টাকার পাশাপাশি স্বর্ণালংকার ও বিদেশি মুদ্রাও পাওয়া যায়।

এই অর্থের প্রকৃত উৎস কী, বিষয়টি জানতে বৃহস্পতিবার উপজেলা প্রশাসন চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিন কার্যদিবস পর তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেবে বলে নিশ্চিত করেছেন তিতাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম মোর্শেদ।

গত ৮ জুলাই নিজ বাড়ির একটি ঘরে বিশা পাগলার মৃত্যু হয়। পরে তার শোবার ঘরে পাওয়া যায় তিনটি বস্তা। মঙ্গলবার এসব বস্তা খোলা হলে বেরিয়ে আসে টাকা, স্বর্ণালংকার ও বিদেশি মুদ্রা।

এত টাকা কীভাবে এলো– এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মাঝে।

কী করতেন বিশা ফকির

কুমিল্লার তিতাস থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি সুধীন চন্দ্র দাশ বলেন, ‘আমি যতটুকু খবর নিয়েছি আমির হোসেন ওরফে বিশা পাগলা আধ্যাত্মিক লোক ছিলেন। তার কাছেও বহু ভক্ত-মুরিদ আসতেন। তারা তাকে মানতের টাকা দিতেন। এ ছাড়া শুনেছি মাজারের নামে তিনি হাত পেতে অর্থ সংগ্রহ করতেন।

‘বিষয়টি ভালো করে জানতে বৃহস্পতিবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই বিশা পাগলার টাকা পাওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’

স্থানীয় বাসিন্দা বেশ কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা বিশা পাগলাকে ‘ফকির’ (আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি) হিসেবে জানেন। তিনি ৪০ বছর ধরে এই টাকা জমাচ্ছেন। তার ইচ্ছা ছিল বাড়ির পাশে জমি কিনে একটি সুন্দর মসজিদ গড়বেন। বাকি টাকা দিয়ে একটি আলাদা ঘর করবেন। সেখানে বসে ফকিরি করবেন।

বিশা পাগলার বড় ভাই আওলাদ হোসেন বলেন, ‘বিশা সারা জীবন ফকিরি করল। বিয়েশাদি করেনি। মসজিদ গড়ার খুব ইচ্ছা ছিল।’

বলারামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. নূরনবী বলেন, ‘আমি টাকা গোনার সময় ছিলাম। অনেক আগের নোট ছিল। সবগুলোই বান্ডিল করা। ৫০০ ও ১০০ টাকার এত পুরোনো নোট ছিল যে সেগুলো গোনার মেশিনে গোনা সম্ভব হচ্ছিল না। মেশিনে বারবার ভুল হচ্ছিল। এত পুরোনো নোট এখন নেই।’

কীভাবে এত টাকা জমানো সম্ভব হলো সে বিষয়ে নূরনবী বলেন, ‘বিশা পাগলার অনেক ভক্ত ছিল। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তার এই ভক্তদের জন্য তিনি ওরস করতেন। সেখানে ভক্তদের টাকায় পাঁচ-ছয়টি গরু জবেহ করা হতো। সেগুলো দিয়ে তাবারক রান্না হতো। আর প্রতি ওরসের পরে যে টাকা বাড়তি থাকত, সেই টাকা তিনি জমাতেন। আমরা যে ঘরে টাকা পেয়েছি, সে ঘরে তার ফকিরি চলত। সেখানে ভক্ত ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ ছিল।

‘বিশা পাগলারা তিন ভাই ও দুই বোন ছিল। তার বাবা-মা ও বড় বোন মারা যান অনেক আগে। সেই বড় বোনের মেয়ে তাসলিমা আক্তার। মা নেই। বাবা জন্মের আগে মারা যান। তাই মামা বিশা পাগলার বাড়িতেই বেড়ে উঠেছে তাসলিমা। বিশা পাগলারে বাবা বলে সম্বোধন করত। বিশা পাগলাও তাকে মেয়ের স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য রমজান ব্যাপারী বলেন, ‘প্রতি বছর বিশা পাগলার উদ্যাগে একটি ওরস হতো। সেই ওরসে হাজার হাজার ভক্ত হাজির হতেন। প্রতি ওরসে তার খরচ হতো লাখ দশেক টাকা করে। সে সময় ভক্তরা তার জন্য গরু, খাসি, মহিষ এবং নগদ টাকা নিয়ে আসতেন। হিসাব করলে দেখা যেত, যে টাকা খরচ করে বিশা পাগলা ওরস করতেন তার চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ বেশি টাকা ভক্তরা দক্ষিণা হিসেবে দিয়ে যেতেন। এটা তার ঘরে পাওয়া টাকার একটা বড় উৎস।

‘দেশ ছাড়াও তার প্রবাসী অনেক ভক্ত ছিলেন। নানা কিছুর মানতে তারাও বিদেশি মুদ্রা দক্ষিণা হিসেবে পাঠাতেন। অনেক নারী ভক্ত ছিলেন। আমরা ধারণা করছি, বেশ কয়েব ভরি যে স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে, সেগুলো নারী ভক্তদের মানত করা।’

ইউপি সদস্য রমজান ব্যাপারী আরও বলেন, ‘আমার মনে আছে টাকা গোনার সময় একটি বস্তায় ৯৩ বান্ডিল ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট পেয়েছি। আরেকটি বস্তায় ১২৫ বান্ডিল। এমন ১০-১২ বান্ডিল টাকা পেয়েছি যেগুলোতে এক একটা বান্ডিলে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত পাওয়া গেছে।’

টাকা কী করা হয়েছে

নূরনবী চেয়ারম্যান জানান, টাকা পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সামনেই বিশা পাগলার দুই ভাই, এক বোন ও ভাগনি তাসলিমার কাছ থেকে স্ট্যাম্প কাগজে স্বাক্ষর রেখে এই টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা এই টাকা গৌরীপুর ব্র্যাক ব্যাংকে যৌথ হিসাব খুলে জমা দিয়েছেন।

টাকা হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন বিশা পাগলার বড় ভাই আওলাদ হোসেন, ছোট ভাই জামাল হোসেন ও বোন মুর্শিদা বেগম, ভাগনি তাসলিমা আক্তার ও বিশা পাগলার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সাইফুল ইসলাম মিঠু। মিঠু বিশা পাগলার চাচাতো ভাই মাহবুবুর রহমানের ছেলে।

বড় ভাই আওলাদ হোসেন জানান, জীবদ্দশায় বিশা পাগলার খুব ইচ্ছা ছিল একটি মসজিদ করার। পৈতৃক সূত্রে ২৯ শতাংশ জমি পেয়েছেন তিনি। এতটুকু জায়গায় মসজিদ হবে না। তাই বিশা পাগলা ৪০ বছর ধরে টাকা জমাচ্ছিলেন। এলাকায় জনকল্যাণমুখী কাজেও টাকা ব্যয় করার ইচ্ছা ছিল তার। তবে মসজিদ করার পরেই সমাজের জন্য কল্যাণকর কাজগুলো করার পরিকল্পনা ছিল বিশা পাগলার।

আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমার ভাই ফকিরি করত। আমাদের ভাইবোনদের সঙ্গে প্রয়োজনের বেশি একটাও অতিরিক্ত কথা বলত না বিশা।’

এই টাকা দিয়ে কী করা হবে জানতে চাইলে আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ভাই, বোন, ভাগনিসহ সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিশার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদ গড়ার জন্য টাকা ব্যয় করব। সে জন্য আমরা এলাকাবাসীর সহযোগিতা নেব। শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকবে।’

বোন মোর্শেদা বেগমও একই কথা বললেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই পির আছিল। আল্লাহওয়ালা লোক আছিল। ভাই যেমনে চাইছে, আমরা হেমনে খরচ কইরাম। আমরার পিছনে এক টেহাও ব্যয় করতাম না। গেরামিওয়ালারা আমরার দুই ভাই, আমি, আমরার ভাগনি ও ভাতিজারে টেহাডি তুইল্লাহ দিছে। আমরাও আল্লাহর রাস্তায় খরচ কইরাম।’

এত টাকার উৎস নিয়ে ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় উপজেলা প্রশাসন। এ ব্যাপারে তদন্ত করতে চায় তারা।

তিতাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা বিশা পাগলার আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে কিংবা কোত্থেকে এত টাকা তার ঘরে জমা হলো বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করতে চার সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করেছি। আজসহ আগামী তিন কার্যদিবসে অর্থাৎ সোমবার পর্যন্ত তদন্ত চলবে। মঙ্গলবার তদন্ত কমিটি আমাকে রিপোর্ট দেবে।’

কাদের নিয়ে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এমন প্রশ্নে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম মোর্শেদ বলেন, ‘একজন গেজেটেড অফিসার, তিতাস থানার একজন কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছেন কমিটিতে।’

এ বিভাগের আরো খবর