ঈদের দিনটি আনন্দে নয়, বিরহ বেদনায় কেটেছে ময়মনসিংহের শফিকুল ইসলামের। তার সন্তানরা মায়ের জন্য কেঁদেছে কেবল।
শফিকুল বলেন, সুখের সংসার ছিল তাদের। বিয়ের পর ১২ বছর একসঙ্গে ঈদ করেছেন। কিন্তু তার স্ত্রীকে নিয়ে উধাও হয়ে গিয়ে সব ওলটপালট করে দিয়েছেন কথিত ফকির খেতা শাহ।
অলৌকিক শক্তির অধিকারী ভেবে খেতা শাহ নামে পরিচিতি পাওয়া ফজলুল হকের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন শফিকুল। আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজ ঘরে। কিন্তু নিজের ভরসা হয়ে ওঠার বদলে সংসারে নিয়ে এসেছেন কষ্ট। ভক্তের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছেন তিনি।
রোববার ঈদের বিকেলে শফিকুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন আমাদের ছোট তিন ছেলেমেয়ে। সন্তানদের ছাড়া তাদের মা ঈদ করবে, এটা কখনও কল্পনাও করিনি। খেতা শাহর জন্য আনন্দের পরিবর্তে কষ্টের ঈদ পেয়েছি আমরা।’
‘আজকের দিনে সবাই আনন্দ করছে। আর আমার তিনটি শিশু তার মায়ের জন্য কান্নাকাটি করছে। তাদের সান্ত্বনা দিয়েও কান্না বন্ধ করা যাচ্ছে না।
‘আমার বৃদ্ধ মা সকালে রান্না করে খাবার দিয়েছে। কিন্তু মাকে ছাড়া কিছুই খেতে চায় না তারা। আমারও গত পাঁচ দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বর। তাই স্ত্রীকে খুঁজতে দূরে কোথাও যেতে পারছি না।‘
শফিকুলের তিন সন্তান। বড় সন্তান ১১ বছর বয়সী। তাকে কোনোভাবে মানাতে পারলেও ৯ বছর ও ৭ বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে বিপাকে তিনি।
ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় কাঁথাকে বলা হয় খেতা। ময়মনসিংহের তারাকান্দার টিকুরী এলাকায় সব সময় ছেঁড়া কাঁথা শরীরে জড়িয়ে রাখতেন। তিনি যা বলতেন তাই হতো- এমন বিশ্বাসে অনেক লোক তার ভক্ত হয়ে যান৷
বৃদ্ধ বয়সে মারা যান সেই ব্যক্তি। কিন্তু থেকে যান ভক্তরা। একপর্যায়ে নির্মাণ করা হয় মাজার। নামকরণ করা হয় 'খেতা ছিঁড়ার মাজার'। প্রতি বছর পালন করা হয় ওরস।
এবারও চার মাস আগে ওরস শুরু হয় ওই মাজারে। বরাবরের মতো এবারও হাজারো ভক্তসহ লোকজন আসেন মনের বাসনা পূরণ করার আশায়।
পাগলবেশে ফজলুল হক তালুকদার নামের একজন আসেন মাজারটিতে। বড় দাড়ি, লম্বা গোঁফ ও ছিঁড়া খেতা গায়ে জড়িয়ে সারাক্ষণ মাজারে বসে সময় কাটাতেন। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে মাজারের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে নিজেকে ‘খেতা শাহ’ হিসেবে পরিচয় দেন৷
৬০ বছর বয়সী ফজলুলের বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার পাইলাটি গ্রামে। তিনি মৃত মনা তালুকদারের ছেলে।
নিজেকে আধ্যাত্মিক ফকির হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেতে কথাও বলতেন খুব কম। এভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেন তিনি।
তাকে বাবা ডেকে অনেকে মনের বাসনা পূরণ করতে দোয়া চেয়ে নিতেন। যারা তার কাছে আসতেন, তাদের অনেককে মাথায় হাত ভুলিয়ে ঝাড়ফুঁক দিতেন। এভাবে কয়েক দিনেই তার ভক্তের সংখ্যা বেড়ে যায়।
আধ্যাত্মিক ফকির ভেবে খেতা শাহের ভক্ত হয়ে যান শফিকুলও। সংসারের উন্নতি আর মনের বাসনা পূরণ হবে- এমন ধারণা থেকে দুই চাচার পরামর্শে নিয়ে আসেন বাড়িতে।
খেতা শাহকে বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় দেন শফিকুল। সেখানে রেখেই আপ্যায়ন শুরু করেন। স্ত্রীকেও বলতেন ঠিকঠাক সেবা করতে।
গত ২২ জুন দুপুর ১২টার দিকে শফিকুলের স্ত্রী বাবার বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় যাওয়ার কথা বলে খেতা শাহকে নিয়ে বের হন। এরপর দুজনই নিখোঁজ হন।
এ ঘটনায় খেতা শাহের নামে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় থানায় লিখিত অভিযোগ দেন শফিকুল ইসলাম। রাত ১২টার দিকে তার অভিযোগ মামলা হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু এখনও পুলিশ কিছু জানাতে পারেনি তাকে।
শফিকুল বলেন, ‘পুলিশ, গোয়েন্দা, সাংবাদিকরা সবাই ভণ্ড খেতা শাহ আমার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি জানতে পেরেছে। এটি দেশের আলোচিত ঘটনা হলেও খেতা শাহকে গ্রেপ্তার করে আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে পারছে না।
‘আমার তিন শিশুর জন্য আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করে দিন। তাদের কান্নার আওয়াজ শুনে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।’
শফিকুলের ১১ বছরের ছেলে নিউজবাংলাকে বলে, ‘আমার ছোট দুইটা বোন খুব ছোট। তারা কিছু না বুঝলেও আমি প্রথমেই ভণ্ডকে সন্দেহ করছিলাম৷ আমার মাকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিয়া গেছে। মাকে ছাড়া থাকতে অনেক কষ্ট হয়৷’
শফিকুলের মা মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘ঈদের আগের দিন থেকে শিশুরা বেশি কান্নাকাটি করছে। বড় নাতিকে কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারলেও ৯ ও ৭ বছরের ছোট দুই শিশু মেয়েকে কিছুতেই সান্ত্বনা দেয়া যাচ্ছে না। তাদের মাকে ছাড়া কিছু খাওয়ানোও যাচ্ছে না। এসব দৃশ্য দেখে আমার খুব কষ্ট হয়। ভণ্ড আমাদের সাজানো গোছানো সংসারটা লণ্ডভন্ড করে পালিয়েছে।‘
এ বিষয়ে তারকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খেতা শাহকে গ্রেপ্তার করতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও তার পালিয়ে থাকার অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না৷ তবে, আশা করছি বেশি দিন পালিয়ে থাকতে পারবে না খেতা শাহ।’