শেরপুরের জনপ্রিয় ও আলোচিত ষাঁড় ইউটিউবার ও চিরকুমার শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি। এতে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা।
শেরপুরের হাটগুলোতে এ বছর বড় গরুর তেমন চাহিদা ছিল না। শেষ দিন পর্যন্ত হাটগুলো ছিল ছোট ও মাঝারি গরুর দখলে।
আর এদিকে ইউটিউবারকে কোনো হাটেই তোলেনি তার মালিক। মালিকের ইচ্ছে ছিল খামার থেকেই বিক্রি করবেন তার ইউটিউবারকে।
কদিন আগেও শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের দুই গ্রাম পশ্চিম কুমরী ও কুমরী মুদিপাড়ায় আলোচনার মূল বিষয় ছিল ইউটিউবার ও চিরকুমার। এদের আকৃতি ও সৌন্দর্য নজর কেড়েছে সবার। কেউ কেনার আশায় দেখতে এসেছেন। আবার অনেকে শুধু এত বড় ষাঁড় দুটি সামনাসামনি দেখার জন্যই এসেছেন।
এত বড় অস্ট্রেলিয়ান হলস্টেল ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড় দুটিকে নিয়ে এখন কী করবেন, এ নিয়েই চিন্তায় মালিক সুমন ও ইব্রাহিম।
৩০ মণ ওজনের ইউটিউবারের মালিক পশ্চিম কুমরীর সুমন মিয়া নিজেও একজন ইউটিউবার। ইউটিউব থেকে আয় দিয়ে তার সংসারে এসেছে সচ্ছলতা, গড়ে তুলেছেন গরুর খামার। খামারে চারটি গরু আছে। এর মধ্যে দুটি ষাঁড়, একটি গাভি ও আরেকটি বাছুর।
সুমন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ইউটিউবে কাজ করেই সবকিছু করেছি। ইউটিউবের রোজগার দিয়ে প্রথম কেনা গরুর নামও রেখেছি ইউটিউবার। আমি ইউটিউবারকে ঘরের বাইরে বের করি না। আর এ জন্য এবার কোনো কোরবানির হাটে তুলিনি তাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাকে এক বছর আগে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। এবার আমি ৭ লাখ টাকায় বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। খামারে এসে ২০০ জনের মতো ক্রেতা এসে দাম করেছিল। সর্বোচ্চ দাম করেছিল চার লাখ ৭০ হাজার টাকা। শেষ পর্যন্ত যে ক্রেতা চার লাখ ৭০ হাজার টাকা দাম করেছিল, তার কাছে বিক্রি করতে চাইছিলাম।
‘কিন্তু সেই লোক অর্ধেক দাম নগদ দিতে চাইছিল আর অর্ধেক বাকি রাখতে চাইছিল। বাকি রাখতে চাইছিল বলে তাকে দিইনি। অনেকে তিন লাখ, কেউ তার কমও দাম করেছিল। আসলে এত কম দামে তাকে দেয়া যায়নি। আমার তাকে লালন-পালন করতেই খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখের মতো।’
সুমন বলেন, ‘আমি আরও কিছুদিন দেখতে চাই। কিন্তু তাকে বিক্রি করার খুব দরকার ছিল। তার যে খরচ তা বহন করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। এই ষাঁড়টাকে প্রতিদিন ৫০০ টাকার খাবার দিতে হয়। তিন থেকে চারবার গোসল করাতে হয়, গোয়ালে ফ্যান আছে যেন গরম না লাগে।’
এদিকে, চার বছর আগে ৯৭ হাজার টাকায় একটি ষাঁড় কিনেছিলেন কুমরী মুদিপাড়ার কৃষক ইব্রাহিম মিয়া। এখন সেই ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৩২ মণ। অনেক দিন ধরে লালন-পালন করা এই ষাঁড়ের নাম রেখেছেন তিনি চিরকুমার। এ ষাঁড়টির দাম চাওয়া হয়েছিল ১০ লাখ টাকা।
ইব্রাহিম বলেন, ‘গত চার বছরে ষাঁড়টির প্রতি ভীষণ মায়ায় পড়ে গেছি। চিরকুমার আমাকে দেখলে খুশি হয়। আমিও চিরকুমারকে ছাড়া থাকতে পারি না। বিক্রি করতে মন চায় না, কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, এ জাতের গরুর বয়স সাড়ে চার বছর পার হলে বেশ ঝুঁকি থাকে। তা ছাড়া ওজন বেশি হয়ে গেলে মানুষের মতো গরুরও নানা সমস্যা হয়। তাই বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
‘অনেক আশায় বুক বেঁধে আরও এক বছর পালার পর এবারও চিরকুমারকে বিভিন্ন হাটে তুলেছিলাম। তখন ভালো দাম না পাওয়ায় বেচতে পারিনি। গতবার হাটে তোলার সময় চিরকুমারের ওজন ছিল ২০ থেকে ২২ মণ। প্রতিদিন তাকে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার খাবার খাওয়াতে হয়। ভুসি, খড়, ঘাস দিই। দুই-তিনবেলা গোসল করানো হয়।’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আর বড় ষাঁড় পালতাম না। এবার হাটে তুলেও কারও কাছ থেকে দাম করতে শুনিনি। ছোট আর মাঝারি গরুর প্রতি চাহিদা বেশি। শখ করে পালছিলাম। এখন তো মেলা বিপদে পড়েছি। বয়স ও ওজন দুইটাই বাড়তি। ওজন বাড়লে মানুষই বাঁচে না। কী যে করি ষাঁড়টারে নিয়া। পালার মতো আমার আর ধৈর্যও নাই। খরচও মেলা। আমি কৃষক মানুষ কেমনে কী করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘খামারে আইসা একজন দাম করছিল ৬ লাখ টাকা। তখন অনেক চিন্তা কইরা বেচি নাই। কারণ আমার তো তাকে পালতেই খরচ হয়েছে ৮ লাখ টাকার মতো।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ বছর শেরপুরে কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল ৫৫ হাজার ৪৬৫টি। প্রস্তুত করা হয়েছিল ৮৪ হাজার ৪১৭টি। ক্রেতারা হাটে গিয়ে এবার স্বাচ্ছন্দ্যে কোরবানির পশু কিনতে পেরেছেন।
‘বাইরের পশু না আসায় বেচাকেনাও ভালো হয়েছে। আমরা হাটের পাশাপাশি অনলাইনেও পশু কেনাবেচার ব্যবস্থা রেখেছিলাম। কিন্তু হাটগুলোতে মাঝারি আকারের পশু বেচাকেনা বেশি হয়েছে। জেলার পাঁচ উপজেলায় ২৭টি কোরবানির হাট ও ৬টি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন খামারির জন্য ষাঁড় বিক্রি করতে না পারার বিষয়টি হতাশাজনক। সাধারণত গরু ১০ বছর পর্যন্ত লালন-পালন করা যায়, তবে এসব বড় ষাঁড়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে। ষাঁড়গুলো অনেক বড় আর মোটা। তবে এ ধরনের বিশাল ষাঁড় সাড়ে চার বছর হলেই বিক্রি করে দেয়া ভালো। না হলে গরুর উচ্চ রক্তচাপসহ নানা সমস্যা হয়।
‘তা ছাড়া আরও কিছুদিন লালন-পালন করলে যে ব্যয় দাঁড়ায়, শেষ পর্যন্ত খরচ ওঠানো নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। এ অবস্থায় খামারির খরচ ওঠাতে বিকল্প কোনো পরিকল্পনা করা যেতে পারে।’