জলের ওপর ভাসছে পুরো বাজার। মুমিনুল হকের দোকানেও পানি। দোকানের মালপত্র সব ওপরে জড়ো করে রাখা।
পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে মুমিনুল হক বলেন, ‘এই হলো আমাদের ঈদ। জলে ভাসা ঈদ। পানির কারণে প্রায় এক মাস ধরে ব্যবসাপাতি নেই। এমন অবস্থায় আর কী ঈদ করব।’
মুমিনুল হক সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী। এই বাজারের পুরোটাই এখনও তলিয়ে আছে পানিতে। বেশির ভাগ দোকানপাটেই পানি।
পানিতে ভিজেই ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে কাপড় কিনতে এসেছেন সায়মা হক। তিনি বলেন, ‘পানির কারণে এইবার ঈদ করার মতো অবস্থা নেই। ঘরে রাখা সব ধান নিয়ে গেছে বানের জল। এইবার আর ঈদে আনন্দ নেই। তবু বাচ্চা তো এসব বোঝে না। তার জন্য কাপড় কিনতে এসেছি।’
সাজ্জাদ মিয়ার অবস্থা আরও খারাপ। সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁওয়ের সাজ্জাদ মিয়ার মাটির ঘর বন্যা ভাসিয়ে নিয়েছে। এখন উদ্বাস্তু অবস্থায় প্রতিবেশীর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। এমন অবস্থায় এসেছে ঈদ।
সাজ্জাদ বলেন, ‘বানের জলে ঘর গেছে। খাওনেরই নিশ্চয়তা নাই। আমাদের আবার কীসের ঈদ।’
তিনি বলেন, ‘ঈদ আনন্দের নয়। আমাদের জন্য আরও কষ্টের। ঈদের দিনও বাচ্চাদের মুখে ভালোমন্দ কিছু খাবার তুলে দিতে পারব না। এটা অনেক বেশি কষ্টের।’
রোববার ঈদুল আজহা। কিন্তু সিলেটের বানভাসিদের মধ্যে নেই ঈদের আনন্দ। দুর্গতরা ব্যস্ত টিকে থাকার সংগ্রামে। জীবন আর জীবিকার দুশ্চিন্তায়।
লাল মিয়ার ঘর ভাঙেনি। তবু তিনি ঘরছাড়া। প্রায় ২২ দিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন তিনি।দক্ষিণ সুরমার জান আলী শাহ আশ্রয়কেন্দ্রে কথা হয় লাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পানি এইখানে ভাসিয়ে এনেছে আমাদের। উদ্বাস্তু অবস্থায় ঈদ পালন করার অবস্থা নেই। মনেও আনন্দ নেই।’
লালের স্ত্রী রাহিমা বেগম বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে আছি। রান্নার সুযোগ নেই। কোনো মতে ইট বসিয়ে একটি চুলা তৈরি করেছি। এখানে ধারাবাহিকভাবে ৫-৬টি পরিবারের রান্না হয়। ফলে এখানে ভালোমন্দ কিছু রান্নার সুযোগ নেই।’
আরেক আশ্রিতা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এই অবস্থায় তো আমাদের কোনো ঈদ নেই। কেউ যদি কোনো খাবার উপহার দেয়, তাহলে বাচ্চাকাচ্চাদের একটু খাওয়াতে পারতাম। কারণ তারা তো বন্যা-দুর্ভোগ এসব বুঝতে চায় না।’
ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ পশু কোরবানি। ফলে ঈদকে ঘিরে আশায় থাকেন খামারি ও পশুর মালিকরা। তাদেরই একজন সিলেটের জকিগঞ্জের জাফর মিয়া।
ঈদে বিক্রির জন্য দুটি গরুকে লালনপালন করেছিলেন জাফর। এগুলো বিক্রির টাকা দিয়েই এবার তার ঈদ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু গত ১৭ জুনের ঢলে ভেসে গেছে জাফর মিয়ার দুটি গরু।
গরু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়া জাফর বলেন, ‘এইবারের মতো কষ্টের ঈদ আর জীবনে আসেনি। এই ঈদের আগে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
তিনি বলেন, ‘বন্যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব পানিত ভাইস্সা গেছে। পরের বাড়িত থাকতাছি। ঈদে কিন্তু কোনতা করবার নাই। সাহায্য-সহযোগিতা পাইয়া কোনো রকমে চলছি। কিন্তু গরু দুইটা তো আর পাইতাম না।’
ওসমানী নগর উপজেলার সাদিপুরের তাজিম উদ্দিনের ঘর থেকেও পানি নামেনি। পেশায় দিনমজুর মো. তাজিম প্রায় এক মাস ধরে কর্মহীন।
মো. তাজিম বলেন, ‘গরু কোরবানি দিতে না পারলেও প্রতি বছর ঈদের সময় মোরগ জবাই করতাম। ঘরে স্ত্রী ভালোমন্দ রান্না করত। আর আশপাশের বাড়ি থেকে গরুর মাংস আসত। কিন্তু এবার কিছুই হবে না বোধ হয়।’
সরকারি হিসেবে সিলেটে চলমান বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৮০ হাজার ঘরবাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে ঘরবাড়ি হারানো ১০ হাজার পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। তবে বেশির ভাগই এখনও ভাঙা ঘর মেরামত করতে পারেননি। এ ছাড়া দুই জেলায় আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কেই ছাপড়া ঘর তৈরি করে আছেন কাইয়ুম আহমদ। তিনি বলেন, ‘এবার সড়কেই আমাদের ঈদ। ছাপড়া ঘরে গরু-বাছুরের লগে একসঙ্গে থাকি। মাইনসের সাহায্যে চলি। ঈদও এইভাবে চলবে।’
এবারের বন্যায় বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে গরু কোরবানি দিয়ে বানভাসিদের মধ্যে মাংস বিতরণেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তেমনই একটি সংগঠন ঊষা। ঊষার সমন্বয়ক তামিস্রা তিথি বলেন, ‘ঈদের সকালে কোরবানি দেয়ার জন্য তিনটি গরু কিনেছি আমরা। এগুলোর মাংস বানভাসিদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিলেটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হাজার পরিবারকে ঈদের আগে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। বাকিদেরও পুনর্বাসন করা হবে। ঈদের দিন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভালো খাবার বিতরণ করা হবে।’