যানজটের কারণে ঢাকার গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস সময়মতো ছাড়তে পারছে না। কোনো কোনো বাস ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা দেরিতে আসছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
শফিকুল ইসলাম ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পে কাজ করেন। ঈদ করতে যাবেন সিরাজগঞ্জ। শ্যামলী পরিবহনের বাস ছাড়ার কথা ছিল শুক্রবার বেলা দেড়টায়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গাড়ি আসেনি।
এই গরমে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন তিনি। সেই দুপুর থেকে গাবতলীতে বাসের অপেক্ষায় থাকার সময় কথা হয় নিউজবাংলার সঙ্গে।
গাবতলী বাস টার্মিনালে শ্যামলী কাউন্টারের মাস্টার মানিক হোসেন সন্ধ্যায় বললেন, ‘গাড়ি এখনও টাঙ্গাইলে আছে। কখন আসবে জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বৃহস্পতিবার থেকে প্রত্যেকটা গাড়ি কয়েক ঘণ্টা করে লেট হচ্ছে। টিকিট বুকিংয়ের কারণে কোনো রিজার্ভ গাড়িও নেই।’
ঢাকা থেকে নাটোর-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে চলাচলকারী গ্রামীণ ট্রাভেলসের সকাল সাড়ে ১০টার বাস বিকেল পৌনে ৪টায়ও ঢাকায় আসেনি বলে কাউন্টার থেকে জানানো হচ্ছিল। কাউন্টারে তখন ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের ভিড়।
হানিফ এন্টারপ্রাইজে নীলফামারী যাবেন আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে চাকরিজীবী মো. জিসান। তার বাস ছিল সাড়ে ৫টায়। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার দিকেও বাসের দেখা নেই। তিনি নিউজবাংলাকে জানালেন, ‘কাউন্টার থেকে বলা হয়েছে যানজটের কারণে গাড়ি ছাড়তে লেট হবে। ৯টা-১০টা বাজতে পারে।’
ঢাকা থেকে বগুড়া, নওগাঁ, রংপুর রুটে চলে শাহ ফতেহ আলী পরিবহন। এই কাউন্টারের এক পরিবহনসংশ্লিষ্ট জানালেন, দুপুর ১২টার গাড়ি এখন বিকেল সাড়ে ৪টায়ও আসেনি। কখন আসবে সেটাও তারা জানে না।
বাস দেরিতে ছাড়লেও যাত্রীদের কাউন্টারে আসতে হয়েছে সময়মতো। যাত্রীদের অপেক্ষার ওয়েটিং রুমগুলোতে তাই ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভিড় বাড়ছিল। প্রবীণ, নারী ও শিশুদের রেখে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের একটু সময় কাটাতে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যায়। কিন্তু কতক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কোথাও একটু বসার জন্য এখানে সেখানে চেষ্টা করতে দেখা যায় শত শত মানুষকে।
ওয়েটিং রুমে ফ্যান থাকলেও বিদ্যুৎ চলে যেতেই তীব্র গরম পড়ে। শিশুরা কাঁদতে শুরু করে। এর মধ্যেই চলছে খাওয়াদাওয়া। সব মিলিয়ে পরিবেশগুলো একেবারেই যাচ্ছেতাই অবস্থা।
সকালে গাবতলী আসেন কলেজছাত্র মো. ইব্রাহিম। আগাম টিকিট ছিল না। যাবেন মাগুরা। তিনি নিউজবাংলাকে বললেন, ‘প্রায় ছয় ঘণ্টা গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি। কোনো টিকিট পাইনি। মনে করেছিলাম পদ্মা সেতু হয়ে গেছে এবার টিকিট পাওয়া যাবে। তাই টিকিট কাটিনি। বেশ কয়েকটা কাউন্টার টিকিট পেলে জানাবে বলে জানিয়েছেন। এই আশায় বসে আছি।’
কুষ্টিয়া যাবেন মানিক মিয়া। ঢাকায় একটি গ্যারেজে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন। সকাল ৮টায় গাবতলী বাস টার্মিনালে এসেছেন তিনি। বিকেল ৫টায় জানান, প্রায় ১৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পরে হানিফ এন্টারপ্রাইজে একটি টিকিট পেয়েছেন। সেই বাস রাত ৮টায় ছাড়বে। বলেন, ‘এখনও তিন ঘণ্টা এখানে বসে থাকা লাগবে।’
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তিন সন্তানকে নিয়ে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বসে রয়েছেন লুৎফা খাতুন। স্বামীসহ পাঁচজন তারা। যাবেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী।
তিনি জানালেন, ‘গাবতলী আসছি তিন ঘণ্টা হইল। এখনও টিকিট পাই নাই। আমার স্বামী টিকিট খুঁজছেন। যদি টিকিট না পাই তাহলে অন্যভাবে ব্যবস্থা করে যাইতে হবে।’
সাতক্ষীরা যাবেন জহুরা খাতুন। সঙ্গে খালা শাশুড়ি মর্জিনা খাতুন, ৯ বছরের ছেলে জাহিদুল ইসলামসহ পাঁচজন। জহুরা জানালেন, সকাল ১০টায় এসেছেন গাবতলী। প্রায় ৫ ঘণ্টা অপেক্ষার পরে দ্রুতি পরিবহনে টিকিট করতে পেরেছেন। যেই বাস রাত ৯টায় ছাড়বে।
তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে টিকিটের জন্য আমাদের মেলা পেরেশানি হইছে।’
সাতক্ষীরার শ্যামনগর যাবেন জামাল উদ্দিন। সঙ্গে রয়েছেন এক বছরের শিশু ও স্ত্রী। বলেন, ‘তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর এখানে এসে টিকিট পেলাম।’
সাতক্ষীরার শ্যামনগর যাবেন আবুল বাশার ঢাকায় একটি পোশাক কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘দুপুর ১২টায় আইছি। তিন ঘণ্টা ট্রাই করে ইঞ্জিন কাভারে সিট পাইছি।’
বিভিন্ন পরিবহন কাউন্টার থেকে জানানো হচ্ছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের তীব্র যানজটের কারণে এই ভোগান্তি। অনেক বাস ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিভিন্ন স্থানে আটকে যাচ্ছে। ঢাকায় ফিরতে সময় লাগছে অতিরিক্ত তিন থেকে চার ঘণ্টা।
দুই মাস আগে ঈদুল ফিতরে ঈদযাত্রায় মানুষ বাড়ি ফিরেছে বলতে গেলে নির্বিঘ্নেই। কোনো পথেই যানজটের ভোগান্তি তেমন একটা ছিল না। টিকিটের জন্য হাপিত্যেসও দেখা যায়নি।
সেবার মোটরসাইকেলে করে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে বাড়ির পথে যায়। যে কারণে বাসে-ট্রেনে চাপ ছিল কম।
আবার ঈদুল ফিতরের ছুটির সঙ্গে দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি এবং মে দিবসের ছুটি যোগ হওয়ায় তখন মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করে আগেভাগেই। আবার ঈদের ছুটির শেষে কেবল একটি কর্মদিবস পরে আবার দুই দিনের ছুটি ছিল। সব মিলিয়ে ৯ দিনের লম্বা বিশ্রামের সুযোগ ছিল মানুষের কাছে।
কিন্তু এবার ঈদের তিন দিনের ছুটির সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটির এক দিন যুক্ত হয়ে মোট ছুটি চার দিনের। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ মূলত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে যাত্রা শুরু করে। এই চাপটা শুক্রবার সকাল রাত অবধি ছিল। সময়মতো গাড়ি ছাড়লে হয়তো এতটা ভিড় হতো না।
গাবতলী থেকে ছাড়ে, এমন একটি পরিবহন কোম্পানির কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, সড়ক ও মহাসড়কের পাশে কোরবানির পশুর হাট বসেছে। মূলত এ কারণে রাস্তায় যানজট।
পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যমুনা সেতু এলাকা ও আমিনবাজার থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত যানজট রয়েছে। গাবতলী পশুর হাটের কারণে শ্যামলী থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত যানজট। পোশাক কারখানাসহ সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে ছুটি দেয়ায় রাস্তায় অনেক মানুষ নেমেছে। এ কারণেও যানজট তৈরি হয়েছে।
ঢাকা থেকে রংপুর যায় আরাফাত ক্যারেজ ওয়েজ। এই ব্যানারে আরাফাত, আগমনী ও শ্যামলী -এই তিনটি পরিবহনের বাস চলে, যাদের কাউন্টার গাবতলীর মাজার রোডে।
আরাফাত পরিবহনের কর্মকর্তা মো. সোহেল জানান, ‘বৃহস্পতিবার থেকে ব্যাপক সিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। কোনো বাস সময়মতো ঢাকায় ফিরতে পারছে না।’
তার পাশে বসা আগমনী পরিবহনের ইউনূস আহমেদও জানালেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘একটি বাসও সঠিক সময়ে ঢাকা ছেড়ে যেতে পারেনি।’
হানিফ পরিবহনের উত্তরবঙ্গগামী কাউন্টারের কর্মী রুবেল হোসেন বলেন, ‘শিডিউল বিপর্যয়ে রয়েছে। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শুক্রবার রাতের গাড়িগুলো ছাড়তে দেরি হবে।’