বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে দেশে বিদ্যুৎ খাতের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা দূর হতে অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে বলে ধারণা করছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। তার আগ পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে অনুরোধ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে সারা দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক এক সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এখন যে অবস্থায় আছি এটা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্টেইন করতে পারলে আমাদের অবস্থার উন্নতি হবে।’
সেপ্টেম্বরের পর কীভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, তার কারণও ব্যাখ্যা করেন তৌফিক। তিনি বলেন, ‘এলএনজির ওপর নির্ভরতার কারণে আমরা যে বিপাকে পড়েছি, তখন কতগুলো কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট আসবে।
‘যেমন আদানির একটি আসবে, রামপাল আসবে, চট্টগ্রামে এস আলমেরটা আসবে, তিন-চার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক প্ল্যান্ট আসবে। কম-বেশি অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট আমরা পাব।’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার নিয়ে কাজ করেছে। এই সময়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানা প্রকল্পের সুফলও পেয়েছে দেশ। এক যুগে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ছয় গুণের বেশি বেড়েছে, উৎপাদনও বেড়েছে চার গুণের বেশি। বিদ্যুতের আরও কয়েকটি বড় বড় প্রকল্প উৎপাদনে আসার অপেক্ষায়।
বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বরাবর গর্ব করে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির পর দেশে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তরল গ্যাস বা এলএনজি আপাতত আমদানি করা হবে না। গ্যাসের ঘাটতিজনিত উৎপাদনের যে সংকট সেটি সমাধান করা হবে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। দেশে এখন দুই হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ গত কয়েক বছরে লোডশেডিং শব্দটা ব্যবহার করত না। তারাই এখন লোডশেডিংয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আর না কেনার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে জানিয়ে তিনি দুঃখও প্রকাশ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ পরিস্থিতির এই কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ আমরা সবার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সবাই পাচ্ছিল। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে উপকরণগুলো সেগুলোর দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। যেমন ডিজেলের দাম বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে, এলএনজির দামসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। কয়লা এখন প্রায় পাওয়াই যায় না।’
বিদ্যুতের এই যাওয়া-আসা শুরুর পর বিএনপি সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করছে। তারা বলছে, দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের এই পরিস্থিতি। দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির আসলে যে কোনো উন্নয়ন হয়নি, এখন তার প্রমাণ মিলছে।
বিদ্যুতের এই পরিস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে এলেন তৌফিক, যিনি বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সরকারের নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যে ম্যানেজমেন্টের কথা বললাম এগুলো যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে ৫০০ মেগাওয়াটের চেয়ে বেশি লোডশেডিং হবে না। আমরা ধরেছি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রিডে সাড়ে ১৪ হাজারের মতো বিদ্যুতের ডিমান্ড হতে পারে।’
সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত কী হবে- এ বিষয়ে তৌফিক বলেন চাহিদা কমানোর কথা।
এরই মধ্যে সরকার রাত ৮টায় বিপণিবিতান বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তৌফিক এলাহী বলছেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অফিস সূচির পরিকল্পনার কথা।
তিনি বলেন, ‘এই পদক্ষেপগুলো যদি আমরা সবাই মিলে নিই তাহলে এটাকে (চাহিদা) সাড়ে ১২ হাজারে নামিয়ে আনতে পারব। তাহলে আর লোডশেডিং হবে না। তবে আমি এখন এটা বলতে চাই না যে হবে না। এটার জন্য সকলের সহযোগিতা চাই।’
বাগেরহাট রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন এখনও চালু করা যাচ্ছে না, সেটিও জানান জ্বালানি উপদেষ্টা। বলেন, ‘প্ল্যান্টটা সিংক্রোনাইজ হতে আরও কিছু কাজ করা লাগবে। ওদের যে সাবস্ট্রেশন এখন এটা বন্ধ। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২১ জুলাইয়ের পরে তারা যদি কাজ শেষ করতে না পারে, তাহলে আমরা এটা ব্যবহার করতে শুরু করব।
‘তখন কিন্তু এখান থেকে ৭০০-৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। বড় পুকুরিয়াতে আমাদের নতুন যে কয়লা উৎপাদন হচ্ছে, সেটা আসতে আরও মাস দেড়েক সময় লেগে যাবে। বর্তমানে যেটা আছে সেটা দিয়েই ওই পর্যন্ত যেতে হবে। স্টকটা আমরা চেষ্টা করছি যাতে সুষম ব্যবহার হয়। আগস্ট মাসের মধ্যে খলিতে ফুল অপারেশন শুরু হবে।’
দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কাপ্তাই নিয়েও কথা বলেন তৌফিক এলাহী। তিনি বলেন, ‘এটাকে সাধারণত আমরা ব্যবহার করি ব্যালান্সিংয়ের জন্য। এটাকে মেইন সোর্স ধরা হয় না। এ কারণে এর ব্যবহারটা অন্য কেন্দ্রগুলোর মতো হয় না। এখন পানি বেশি আছে, এখন নিশ্চয়ই প্রোডাকশন বেশি হবে।’