পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এবার কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলের জন্য অপেক্ষার পালা শুরু। মাস পাঁচেকের মধ্যে দেশে আরেকটি স্বপ্ন ছোঁয়ার হাতছানি। ডিসেম্বরের মধ্যে খুলে দেয়া হতে পারে এ টানেল।
এরই মধ্যে টানেলের কাজ শেষ হয়েছে ৮৭ শতাংশ। বাকি ১৩ শতাংশ শেষ হতে পারে আগামী চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে।
চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে কর্ণফুলীর তলদেশে এই টানেল নির্মাণ। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার হলেও এর সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের দুই পাশের ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হাইওয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে। তা ছাড়া টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যর পর একটি উড়াল সেতুও রয়েছে।
টানেলে ১০ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের প্রতিটি টিউবের দূরত্ব অন্তত ১১ মিটার। দুই টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেনে চলাচল করবে যানবাহন। এসব টিউবের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৬ মিটার, টিউবের ভেতরের উচ্চতা ১৬ ফুট।
কাজ শেষ ৮৭ শতাংশ
ইতোমধ্যে টানেলের ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনর রশীদ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টানেলের বাকি কাজ নির্ধারিত সময়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশা করছি।’
তিনি জানান, ইতোমধ্যে টানেলের দুই পাশের সংযোগ সড়কের কাজ শেষের দিকে। শেষ হয়েছে আনোয়ারা প্রান্তের উড়াল সেতুর কাজ। সম্পূর্ণ প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত ৩৮২ দশমিক ১৫৫১ একর ভূমির মধ্যে অধিগ্রহণ করা শেষ হয়েছে ৩৬৮ দশমিক ১৫৫১ একর ভূমি। সার্ভিস এরিয়ার বাকি ১৪ একর ভূমির অধিগ্রহণও শেষ হবে শিগগিরই। টানেলের হার্ডওয়্যার স্থাপন, বিবিএবিল্ডিং নেটওয়ার্কিং এবং সফটওয়্যার কাস্টমাইজেশনের কাজও শেষ হয়েছে শতভাগ।
মূল টানেলে প্রথম টিউবে রিং প্রতিস্থাপনসহ বোরিংয়ের কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের আগস্টে। উদ্বোধনের পর প্রথম টিউবের কাজ শেষ হতে সময় লাগে ১৭ মাস। তবে দ্বিতীয় টিউবের কাজ শেষ হতে সময় লাগে মাত্র ১০ মাস। গত বছরের ৭ অক্টোবর শেষ হয় এই টিউবের কাজ। দুটি টিউবের ল্যান স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজও শতভাগ শেষ হয়েছে।
তা ছাড়া দুটি টিউবে ৯ হাজার ৭৮৪ ও ৯ হাজার ৮৩২টি করে মোট ১৯ হাজার ৬১৬টি সেগমেন্টে প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে টানেলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর কাজ চলছে। কাজ চলছে সার্ভিস এরিয়ায়ও।
করোনার বাধা
প্রকল্প পরিচালক জানান, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে করোনা ছড়িয়ে পড়লে এর প্রভাব পড়ে টানেলের নির্মাণকাজেও। ওই বছরের মার্চ থেকে টানা ৭ মাস কাজের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি। এ সময় কাজ এগিয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।
মূলত চীনের সাংহাই বন্দরে লকডাউনের কারণে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সরবারহ ব্যাহত হওয়ায় টানেলের কাজে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন
যানবাহন চলাচলের জন্য বঙ্গবন্ধু টানেলটি খুলে দেয়া হলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে চট্টগ্রামে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহর ও সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হয়ে উঠবে।
চট্টগ্রাম থেকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাঠগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে প্রবেশ করা যাবে টানেলে। টানেলকে ঘিরে শহরেও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস্ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে টানেল যোগাযোগের জন্য খুলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। ফলে শহরে যানবাহনের চাপ বাড়বে। তাই এর আগেই এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে নিমতলা পর্যন্ত অন্তত আট কিলোমিটার খুলে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।
‘এ ছাড়া টানেলের কথা মাথায় রেখে এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। শহরের সড়ক নেটওয়ার্কেও কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টানেল ঘিরে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ প্রান্তে তৈরি হচ্ছে একাধিক নতুন সড়ক। চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেড এলাকা অর্থাৎ টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে কালাবিবি দিঘির মোড় হয়ে পটিয়া-বাঁশখালি-আনোয়ারা (পিবিএ) সড়ককে যুক্ত করছে টানেল সড়ক।
অন্যদিকে কর্ণফুলীর শিকলবাহা থেকে কালাবিবি দিঘির মোড় পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আরেকটি সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ বাঁশখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে ধীরে ধীরে।
আগে আনোয়ারা থেকে সড়কপথে কর্ণফুলী ব্রিজ হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে সময় লাগত তিন থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা।
টানেলটি উন্মুক্ত করে দেয়া হলে আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা যাবে মাত্র আধ ঘণ্টায়। এই সুবিধার আওতায় থাকবে পুরো চট্টগ্রামবাসী। টানেল দিয়ে কর্ণফুলী পার হয়ে দ্রুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মূল শহরে প্রবেশ করতে পারবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ।
সহজ হবে আমদানি-রপ্তানি
বঙ্গবন্ধু টানেল খুলে দেয়া হলে সহজ হবে আমদানি-রপ্তানিও। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাশে আনোয়ারায় রয়েছে চায়না ইপিজেড, সিইউএফএল, কোরিয়ান ইপিজেড, পারকি সমুদ্রসৈকত। এ ছাড়া টানেল ঘিরে এখন নতুন করে বেশ কিছু শিল্প-কারাখানা গড়ে উঠছে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে। চট্টগ্রাম পেরোলে কক্সবাজারে রয়েছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও টেকনাফ স্থলবন্দর।
টানেল খুলে দেয়া হলে বন্দরের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি যুক্ত হতে পারবে। এতে আমদানি-রপ্তানি সহজ হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টানেল খুলে দেয়া হলে কানেকটিভিটি বাড়বে। শহরের বিস্তার ঘটবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। শিল্পায়ন হবে, বাড়বে কর্মযজ্ঞও। কক্সবাজারে হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। যেহেতু যোগাযোগটা সহজ হবে, তাই আমদানি রাপ্তানিও বাড়বে। এটি তুলনামূলক সহজ হবে।’
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং টানেল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। টানেলটির নির্মাণকাজ করছে চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ধরা হলেও ২০১৭ সালে তা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা করা হয়।