দিনে তীব্র তাপদাহ, রাতে ভ্যাপসা গরম। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্বিষহ মাত্রায় বেড়েছে লোডশেডিং। সব মিলিয়ে নওগাঁর গ্রাম ও শহরের জনজীবন অতিষ্ঠ।
লোডশেডিংয়ের কারণে আউশ ও রোপা আমনের ক্ষেতে সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে কলকারখানায়।
লোডশেডিংয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নওগাঁর কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গ্যাসস্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছেন। এ কারণে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহে নওগাঁর গ্রাম ও শহরে লোডশেডিং বেড়েছে। দিনরাত প্রায় সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে গ্রাম এলাকায়। এসব এলাকার শতভাগ গ্রাহকই পল্লী বিদ্যুতের।
নওগাঁ পল্লী সমিতি-১ ও সমিতি-২ এর কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে নওগাঁয় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ৭ লাখ ৮৫ হাজার। এই পরিমাণ গ্রাহকের প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা ১৫২ মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অফ বাংলাদেশ লিমিডেট চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
বর্তমানে নওগাঁর বিভিন্ন এলাকার ফসলি মাঠজুড়ে আউশ ধান রোপণের কাজ চলছে। কৃষকরা রোপা আমন রোপণের জন্য বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। বৃষ্টি না থাকায় কৃষকেরা গভীর-নলকূপ থেকে জমিতে সেচ দিয়ে জমি প্রস্তুত করছেন। এ ছাড়া নওগাঁয় চালকলসহ ছোটবড় প্রায় ২ হাজার কলকারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা থাকে। পাশাপাশি প্রচণ্ড গরমের কারণেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
যা বলছেন গ্রাহকরা
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলা গ্রামের বাসিন্দা রবিন হোসেন বলেন, ‘প্রায় এক সপ্তাহ ধরে শুধু রাতেই পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ধরে লোডশেডিং হচ্ছে। গরমের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।’
আত্রাই উপজেলার নওদুলি গ্রামের বাসিন্দা তৌফিক হাসান বলেন, ‘শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি সমস্যা। গ্রামে কারেন্ট গেলেই মনে হয় আর আসার খবর নাই। এত গরম হচ্ছে তার মধ্যে দিন ও রাতের বেশির ভাগ সময় লোডশেডিং হচ্ছে।’
তীব্র গরম ও লোডশেডিং বিড়ম্বনায় শহরবাসী
নওগাঁর উকিলপাড়া মহল্লার গৃহিণী শান্তা বেগম বলেন, ‘বিদ্যুৎ যায় আর আসে। এক ঘণ্টা থাকলে আবার দেড় থেকে দুই ঘণ্টা থাকছে না। এদিকে আবার রোদ-গরম। খুব অশান্তি অনুভব করছি। বাচ্চার ঠিকমতো পড়াশোনাও হচ্ছে না। দ্রুত সমস্যার সমাধান না করা হলে অসুস্থ হয়ে যাব আমরা।’
শহরের তাজের মোড়ের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মতো বয়স্ক মানুষকে গরমে খুবই অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। একে তো গরম, তার মধ্যে আবার লোডশেডিং, খুবই সমস্যা হচ্ছে।
‘শারীরিকভাবে আমি খুবই অসুস্থবোধ করছি। এমন লোডশেডিং বন্ধে সরকারকে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি।’
লোডশেডিংয়ে চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা কৃষকদের
লোডশেডিংয়ের কারণে জমিতে সেচ দিতে বিড়ম্বনায় পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা। বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় সেচব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
জেলার রাণীনগর উপজেলার মালশন গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে ঠিক সময় পানি সেচ করা যাচ্ছে না। জমিতে সময়মতো পানি দিতে না পারলে ফসলের ক্ষতি হবে। দিন ও রাতে বেশির ভাগ সময় ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকছে না।’
ইমদাদুল হক নামের স্থানীয় আরেক কৃষক বলেন, ‘এখন আমন মৌসুম চলছে। জমিতে ঠিকমতো পানি না দিলে ধান রোপণ ব্যাহত হবে। বিদ্যুৎ তো ঠিকমতো থাকছেই না। কৃষকরা যাতে ঠিকমতো বিদ্যুৎ পায়, সেদিকে সরকারের বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।’
ছোট-বড় কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত
লোডশেডিংয়ের কারণে নওগাঁ বিসিক শিল্প নগরীসহ ছোট-বড় কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন কারখানাগুলোতে কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের।
জেলা শহরের ফিরোজপুর মোড় এলাকায় অবস্থিত জাহেরা রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক বলেন, ‘বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবং মিলের গুদামে ধানের মজুত থাকলে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ মণ চাল উৎপাদন হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন চাল উৎপাদন এখন ১৫০ মণের নিচে নেমে এসেছে।
‘শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে ক্রমেই লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে।’
মহাদেবপুর উপজেলা সদরের জামান রাইস মিলের মালিক জামান দেওয়ান বলেন, ‘বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ পাচ্ছি না আমরা। আমাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে এমন সমস্যা চলছে। এমনটা চলতে থাকলে বড় ধরনের লোকশানের মুখে পড়তে হবে আমাদের। তাই দ্রুত বিদ্যুৎ লোডশেডিং বন্ধ করতে বিদ্যুৎ বিভাগের দৃষ্টি কামনা করছি।’
কী বলছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা
মুঠোফোনে কথা হয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অফ বাংলাদেশের লিমিটেডের রাজশাহী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গ্যাসের চাপ কম থাকায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন।
‘আমরা রাজশাহী থেকে শুধু অপারেশনাল কাজটা দেখে থাকি। জাতীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, স্থানীয় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থেকেই লোডশেডিং করা হচ্ছে। তবে আশা করা হচ্ছে আগামী দুই দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’
নওগাঁ পল্লী সমিতি-১ এর উপমহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) প্রকৌশলী লুৎফুল হাসান সরকার বলেন, ‘নওগাঁ পল্লী সমিতি-১- এর গ্রাহকসংখ্যা ৪ লাখ ৬০ হাজার। এই পরিমাণ গ্রাহকের প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ৯০ মেগাওয়াট। তবে বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ মেগাওয়াট করে।
একই পরিস্থিতি নওগাঁ বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর গ্রাহকদেরও। নওগাঁ বিদ্যুৎ সমিতির-২-এর জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার সাহা জানান, তাদের ৩ লাখ ২৫ গ্রাহকের প্রতিদিন গড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ৬২ মেগাওয়াট। বর্তমানে মিলছে ৩০ থেকে ৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।