গত ১৫ জুন বানের পানি উঠেছিল ফরিদ মিয়ার ঘরে। ২০ দিনেও তা নামেনি। রোদ উঠলে পানি একটু কমে, বৃষ্টি হলে আবার বেড়ে যায়।ফরিদ মিয়ার বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে। মঙ্গলবার সকালে তিনি বলেন, ‘পানি মনে হচ্ছে চোর পুলিশ খেলছে। দিনের বেলা রোদ উঠলে পানি একটু কমে, রাতের বেলা বৃষ্টি হলে আবার বেড়ে যায়।
‘২০ দিন ধরেই পানির ওপর আছি। পা একেবারে পচে গেছে। নিজেকে এখন জলে বাস করা প্রাণী মনে হচ্ছে।’সিলেটে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ের উপজেলার নাম দক্ষিণ সুরমা। এখানকার অনেকটা অংশ সিলেট সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। সিটি করপোরেশন ও উপজেলা মিলিয়ে দক্ষিণ সুরমার ১৪ থেকে ১৫টি এলাকা ২০ দিন ধরে জলমগ্ন হয়ে আছে। দীর্ঘদিনেও পানি না নামায় এসব এলাকার মানুষের দুর্ভোগ পরম পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে।
পানিতে এখনও তলিয়ে আছে দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজ। ফলে ১৫ জুন থেকেই বন্ধ রয়েছে ওই কলেজের পাঠদান।দক্ষিণ সুরমা কলেজের পাশেই কায়সার আহমদের মুদির দোকান। তিনি বলেন, ‘দোকান থেকে কিছুতেই পানি নামছে না, রাস্তাঘাটেও পানি। এভাবে আর কতদিন চলবে কে জানে।’মঙ্গলবার সকালে দক্ষিণ সুরমার আলমপুর, গোটাটিকর, গঙ্গারামের চক, মনিপুর, বঙ্গবীর সড়ক, লাউয়াই, ধরাধরপুর, মোমিনখলা, রায়েরগাঁও, লাউয়াইন, কামুসনা তেতলীসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এর সবগুলো এখন পর্যন্ত জলমগ্ন হয়ে আছে। সড়কের কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানি। অনেকের বাসাবাড়ি ও দোকানের ভেতরেও পানি।সদ্য বিলুপ্ত কুচাই ইউনিয়নের (বর্তমানে সিসিকের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য সবুজ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমার ঘরেও পানি, আর সড়কে তো কোমর সমান পানি। নিজেই চরম দুর্ভোগে আছি।‘বন্যা আগেও হয়ছে। কিন্তু পানি এসে কয়েক দিন পর নেমে গেছে। এবার কিছুতেই নামছে না। পানি স্থির হয়ে আছে।’
লাউয়াই এলাকার সাবিনা আক্তার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘বন্যার কারণে সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবী নারীরা।কারণ, প্রতিদিন অফিসে যেতে ছেলেরা কাপড় গুটিয়ে পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে পারে, কিন্তু একটি মেয়েদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এ কারণে আমাকে প্রতিদিন অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে অফিসে যেতে হয়। অফিসে গিয়ে ভেজা পোশাক পরিবর্তন করতে হয়।’কলাগাছ ও টায়ারের তৈরি ভেলায় চেপে জলমগ্ন সড়ক পেরোচ্ছিলেন মণিপুরের ফজুল মিয়া। তার ঘরেও পানি। পাশ্ববর্তী আরেক বাসার তিন তলায় পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।ফজলু মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পানি থাকার ফলে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় গর্ত ও খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এই সড়ক দিয়ে হাঁটাচলা সম্ভব নয়। আবার ঘরে বসে থাকলেও তো হবে না। তাই ভেলাটি তৈরি করেছি।’
বঙ্গবীর রোডের ব্যবসায়ী সামসুল ইসলাম বলেন, ‘২৫ বছর ধরে ব্যবসা করছি কিন্তু এমন অবস্থা কখনই হয়নি। জুন মাসের ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় হঠাৎ সড়কে পানি উঠে দোকানে ঢুকে পড়ে। সে সময় মেঝেতে থাকা মালামাল তুলে কিছুটা ওপরে রাখা হয়েছিল। পরদিন পানি বেড়ে হাঁটু সমান হয়ে যায়।
‘সে সময়ও তেমন পাত্তা দিইনি। এর পরদিনই পানি বেড়ে বুক সমান হয়ে যায়। এতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে থাকা প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল ভেসে গেছে। এখন পথে বসার উপক্রম।’এদিকে এসব এলাকার বাসিন্দাদের অনেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ারও অভিযোগ করেছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজম খান বলেন‘, ত্রাণ পর্যাপ্ত বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ তিনি বিতরণ করছেন।’২০ দিনেও পানি না নামা প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘নদী, হাওর, বিল, ড্রেন সব পানিতে ভরে গেছে। তাই সড়ক ও বাড়িঘর থেকে পানি নামতে পারছে না। তবে সিটি করপোরেশন ছড়া, খালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে অভিযান চালাচ্ছে।’সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, ‘সিলেটের নদ-নদীর পানি সুনামগঞ্জ দিয়ে নামে। সুনামগঞ্জে পানি বেশি থাকায় পানি দ্রুত নামতে পারছে না, আটকে আছে।’