চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় মামলার এক মাসেও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের দাবি, আসামিরা পলাতক; চেষ্টা চলছে গ্রেপ্তারের।
গত ৪ জুন রাত ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে প্রথমে আগুন ও পরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সে সময় কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে দফায় দফায় বিস্ফোরণে বাড়ে আগুনের ভয়াবহতা।
বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এতো বেশি ছিল যে, আশপাশের চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কেঁপে ওঠে। ওই রাতেই ঘটনাস্থল থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় দুই শতাধিক হতাহতকে।
১৩ জুন পর্যন্ত আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী রয়েছেন অন্তত ১০ জন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।
ঘটনার পর দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। কিন্তু এরপরও মামলা করতেই পুলিশের সময় লেগে যায় তিন দিন। ৭ জুন মধ্যরাতে বিস্ফোরণের ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকী ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনের নামে মামলা করেন।
এজহারনামীয় ৮ আসামির সবাই বিএম কনটেইনার ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারী।
তারা হলেন ডিপোর উপ মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার খান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (প্রশাসন) নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ, ডিপোর শেডের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম এবং সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলাম।
এর মধ্যে নুরুল আক্তার খানকে করা হয় প্রধান আসামি। ডিপোর বিস্ফোরণে তার নিজেরই একটি হাত উড়ে গেছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।
তার নিকটাত্মীয় মেজবাহ উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগুন লাগার সময় তিনি (নুরুল) ডিপোতে ছিলেন না। ডিউটি শেষে ওইদিন বিকেলে বাসায় চলে গিয়েছিলেন। রাতে আগুন লাগার খবর শুনে ডিপোর ভেতর আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। এসময় বিস্ফোরণে তার বাম হাত উড়ে যায়। ক্ষত হয় শরীরের বিভিন্ন জায়গায়।’
বিস্ফোরণে মামলার ২ নম্বর আসামি ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমানের শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে যায়। আগুন নেভাতে গিয়ে আহত হওয়া সত্ত্বেও মামলার আসামি করাটাকে আমানবিক বলছে তার পরিবার।
খালেদুরের জামাতা রাকিব ফাহিম বলেন, ‘আগুনের সময় ডিউটি না থাকায় তিনি বাসায় ছিলেন। আগুন লাগার খবর শুনে ডিপোতে গিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছেন। বিস্ফোরণে তার শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছেন। এখনো সুস্থ হননি। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
‘এখন যেই মানুষটা কোম্পানির কাজ করতে গিয়ে নিজের শরীর পুড়ে ফেলল, তাকেই যদি মামলার আসামি করা হয়, এটা খুবই আমানবিক।’
ডিপোর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৩০ দিন পার হয়েছে সোমবার। এক মাসেও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার হয়নি।
আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে সাত কমিটি গঠন করা হলেও প্রতিবেদন জমা পড়েছে মাত্র একটির। ছয় কমিটির প্রতিবেদন এখনো জমা পড়েনি। এসব প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল তিন থেকে সাত দিন।
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত হচ্ছে। গোপনীয়তা রক্ষার্থে তদন্ত সম্পর্কে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে মামলার আসামিরা পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।’
এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলাই হয়েছে মূলত সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্য, এটা নিছক আইওয়াশ।
‘এই মামলার আসামি ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা মালিকপক্ষের কেউ না। দোষীদের শাস্তির জন্য এই মামলা করা হয়নি। এদেশে কোনো ঘটনায় শিল্পপতিদের বিচার হয়নি। আর ডিপোতে যারা মারা গেছেন, এদেশে তাদের জীবনের দাম দূর্বাঘাসের চেয়েও কম।’
দুর্ঘটনায় দায়ীরা বিচারের আওতায় আসবে না বলে মনে করছেন তিনি। বলেন, ‘আমাদের জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সবসময় পয়সাওয়ালাদেরই কর্তৃত্ব করে। তাই প্রকৃত দোষিদের বিরুদ্ধে মামলা হবে না, মামলা হলেও গ্রেপ্তার হবে না, এটাই স্বাভাবিক।’
নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানাধীন (জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি) প্রতিষ্ঠান বিএম কনটেইনার ডিপো সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায়। বাংলাদেশে এর মালিকানা স্মার্ট গ্রুপের। গ্রুপের চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমানই ডিপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তার ছোটভাই মো. মুজিবুর রহমান।
এই ডিপোতে গত ৪ জুন রাত ৯টার দিকে আগুন লাগে। প্রথম বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে রাত ১১টার দিকে। এই বিস্ফোরণেই মূলত হতাহতের ঘটনা ঘটে।
একে একে ছুটে যায় চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা থেকেও পরে যোগ দেয় কয়েকটি ইউনিট। ৫ জুন সকাল পর্যন্ত আগুন নেভাতে আসা ইউনিটের সংখ্যা বেড়ে হয় ২৫টি। কিন্তু কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে দফায় দফায় বিস্ফোরণে বাড়ে আগুনের ভয়াবহতা।
৮৭ ঘণ্টা পর ৮ জুন দুপুরে বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন নেভে। সাংবাদিকদের বুধবার দুপুর ১২টার দিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল।
আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় একে একে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৯ জন।