নড়াইলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ সাম্প্রতিক সময়ে দেশে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাগুলোর পেছনে সাম্প্রদায়িক উসকানি রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলের আয়োজনে এক অনুষ্ঠান শেষে রোববার রাতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।
দীপু মনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনা মনে হয়েছে পূর্বপরিকল্পিত।’ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে ক্যাম্পাসে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।
এরপর পুলিশ পাহারায় তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। শিক্ষক স্বপন কুমার হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।শুরুর দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষকের গলায় মালা পরনোর ঘটনাটি অস্বীকার করা হয়। তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শওকত কবীরের সামনেই জুতার মালা পরানো হয় অধ্যক্ষের গলায়। এ ঘটনায় ওসি শওকতকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় গ্রেপ্তার চার আসামিকে রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে পুলিশের সামনে জুতার মালা পরানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ছবি: সংগৃহীত
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বী কয়েকজন শিক্ষককে হেনস্তা করা হয়েছে। তাদের নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া একজন শিক্ষককে হত্যাও করা হয়েছে। আরেক শিক্ষক সনাতন ধর্মের নয়, তাকে এবং তার স্ত্রীকে হুমকি দেয়া হয়েছে, কারণ তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পুরো বিষয়টি দেখে মনে হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে।’
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে আমরা দেখছি, আমাদের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে চরম অসত্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ধর্ম শিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে, যা একেবারে ভুল তথ্য। ধর্ম শিক্ষা চিরদিনই আবশ্যিক, এখনও আছে এবং ধর্ম শিক্ষাকে বাদ দেয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের কখনো ছিল না। এখনও নেই।’
নির্বাচনের আগে স্বাধীনতার অপশক্তি আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বলেও মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী। বলেন, ‘আমরা দেখেছি, আমাদের এই দেশে ধর্মের নামে কিছু মানুষ একাত্তরের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। বাঙালিকে তারা হত্যা করেছে, তারা নারী ধর্ষণ করেছে, লুণ্ঠন করেছে। সেই অপশক্তি আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে নির্বাচন রেখে। আমি মনে করি, সচেতন সবার এই বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার এবং এই অসত্য অপপ্রচারকে বন্ধ করার জন্য সবার ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দীপু মনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি ‘আমরাও পারি’। পদ্মা সেতু নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। চলমান আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প কয়েক বছরের মধ্যে বাস্তবায়িত হলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবসহ বিশ্বময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে পরিবর্তন ও অগ্রগতি হচ্ছে, তার জন্য আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরাও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফল অংশীদার হতে চাই। শিক্ষাক্ষেত্রে সামনে পরিবর্তনের বদলে রূপান্তর আসছে।’’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে, হাতে-কলমে জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং তা প্রয়োগ করতে পারে, শিক্ষা যাতে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, শিক্ষা যাতে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে, সেজন্য কারিকুলামসহ শিক্ষাধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। ‘আমাদের নতুন কারিকুলামে শিক্ষার ফোকাসগুলো বদলে গেছে। মুখস্থ বিদ্যা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের বাস্তবিক শিক্ষায় এগোতে হবে। ভবিষ্যতে শিক্ষায় বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে। আমরা মনে করি, শিক্ষাই হবে পরবর্তী মেগা প্রকল্প। যার মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।’
অনুষ্ঠানে রাজধানীর ধানমণ্ডি থেকে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে সড়কপথে তিনঘণ্টায় খুলনায় আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন মন্ত্রী। বলেন, ‘পদ্মা সেতু হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশপ্রেমের প্রতিচ্ছবি। তার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ পেয়েছি। এখন আমরা ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এখন আমরা ইনোভেটিভ বাংলাদেশ হতে চাই। আমরা সবাই এর সঙ্গী হবো।’
ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন এসটিইএম অ্যান্ড দ্য ফোর্থ ইন্ড্রাসট্রিয়াল রেভ্যুলেশন-২০২২ শিরোনামে সম্মেলনের সামপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য প্রফেসর সাজ্জাদ হোসেন, প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপাচার্য প্রফেসর মাহমুদ হোসেন, পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপউপাচার্য প্রফেসর মোসাম্মাৎ হোসনে আরা বক্তব্য রাখেন। সম্মেলন আয়োজক কমিটির সভাপতি বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলের ডিন প্রফেসর আফরোজা পারভীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর হায়দার আলী বিশ্বাস।
আয়োজক কমিটি, অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমাদের প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে বড় মাইলফলক। এটা আমাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন সূচিত করবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে এবং ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি যৌথ উদ্যোগ ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনে উৎসাহ জোগাবে।’ এই সম্মেলনকে অত্যন্ত সফল ও চমৎকার বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।
একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর টর্চারসেলকে বধ্যভূমি স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ায় তিনি ইউজিসি ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। বলেন, ‘এটি সংরক্ষণের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে পারবে।’
সমাপনী পর্বে সম্মেলনের সফলতা তুলে ধরেন প্রফেসর আশিক উর রহমান। এ ছাড়া সমাপনী অনুষ্ঠানে ৪ জনকে ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’ ও একজনকে বিডি স্টিম বেস্ট স্টুডেন্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রোববার বিকেলে পৌঁছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ‘কালজয়ী মুজিব’-এ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
শিক্ষামন্ত্রী ক্যাম্পাসে পৌঁছালে তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান উপাচার্য মাহমুদ হোসেন ও উপউপাচার্য মোসাম্মাৎ হোসনে আরা।