রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার পাট্টা ইউনিয়নের সদস্য ফয়েজুর রহমানকে গত বুধবার গুলি করে হত্যা করে একদল মুখোশধারী। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। কারা কেন তাকে হত্যা করল, তা নিয়েও বাহিনীর সদস্যরা আছেন অন্ধকারে। পরিবারের লোকজন হত্যার কারণ হিসেবে চাঁদাবাজির বিষয়টি সামনে আনলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছুই বলা যাবে না।
নিহত ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফয়েজুর পাট্টা ইউনিয়নের বিলমন্ডম (তেবাড়িয়া) গ্রামে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। দুই সন্তানের জনক এই ইউপি সদস্য পেশায় পল্লি চিকিৎসক ছিলেন। স্থানীয় বাহের মোড় বাজারে ভাড়া দোকানে ওষুধও বিক্রি করতেন তিনি। তাকে হত্যার ঘটনায় বড় ছেলে নাইমুর রহমান বৃহস্পতিবার মামলা করেন।
এজাহারের কপি (অনুলিপি) পেতে যোগাযোগ করা হয় কালুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হাসানের সঙ্গে। তিনি কপি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বলেন, ‘তদন্তের জন্য মামলার কপি এই মুহূর্তে দিতে পারব না। আসামি ধরার পর এজাহারের কপি দিতে পারব।’
মামলার বাদী নাইমুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলার কপি পুলিশ আমাদের এখনও দেয়নি।’
কুমড়িরানী গ্রামের এই সড়কে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপি সদস্য ফয়েজুর রহমানকে। ছবি: নিউজবাংলা
ফয়েজুর হত্যা মামলাটি তদন্ত করছেন কালুখালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হাসান শেখ। তিনি জানান, মামলায় ছয়-সাতজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় কৃষক মো. সাহাউদ্দিনের সঙ্গে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার সময় বুধবারর সন্ধ্যায় গুলি করে ফয়েজুরকে হত্যা করা হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজবাড়ী শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর রোববার কুমড়িরানী গ্রামে যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক। সেখানে কথা হয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. সাহাউদ্দিনের সঙ্গে।
সাহাউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাহের মোড় থেকে এক কিলোমিটার দূরে কুমড়িরানী গ্রামে পৌঁছালে রাস্তার পাশের পাটক্ষেত থেকে সাত-আটজন মুখোশধারী ভ্যানের গতিরোধ করে। তখন মুখোশধারীরা আমাকে ও ভ্যানচালক জুনাব মণ্ডলকে গালাগাল করে দৌড়ে পালাতে বলেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে মেম্বার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি রাস্তার পাশে পড়ে যান। মুখোশধারীরা খুব কাছ থেকে গুলি করে পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে চলে যায়।’
ফয়েজুর হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী কৃষক মো. সাহাউদ্দিন। ছবি: নিউজবাংলা
তার সঙ্গে কথা শেষ করে নিউজবাংলার প্রতিবেদক যান তেবাড়িয়া গ্রামে ভ্যানচালক জুনাব মণ্ডলের বাড়িতে। তবে সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী চায়না বেগম জানান, ভ্যান নিয়ে তিনি বাইরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে।
জুনাব মণ্ডলের বাড়ি থেকে প্রতিবেদক যান একই গ্রামের ফয়েজুর মেম্বারের বাড়িতে। সেখানে কথা হয় তার স্ত্রী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে। স্বামীকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠেতে পারেননি তিনি।
ফিরোজা বেগম জানান, তার বড় ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ১৫ বছরের ছোট ছেলে জয় মণ্ডল পড়ে স্কুলে। অভাবের সংসারে স্বামীকে হারিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন।
তিনি আরও জানান, ৯ বছর আগে ২০১৩ সালে ফয়েজুরকে হত্যার চেষ্টা হয়। সে সময় পাট্টা ইউনিয়নের আধারকোটা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মৃত্যু হয় তার সঙ্গী পাট্টা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার দেবশ শীল। গুলিবিদ্ধ হন ফয়েজুরও। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন তিনি। ওই ঘটনায় জড়িতরা শাস্তির আওতায় এলে এভাবে মরতে হতো না ফয়েজুরকে।
নিহত ইউপি সদস্যের স্ত্রী ফিরোজা বেগম। ছবি: নিউজবাংলা
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ আমার স্বামীর কাছ থেকে চাঁদা নিত। ফোন করে কখনও ৫০০, কখনও ১ হাজার টাকা চাইত। সব সময় এই টাকা দিতে পারত না সে। এ কারণে ওরা ক্ষিপ্ত ছিল। আমাদের ধারণা, ওরাই গুলি করে হত্যা করেছে আমার স্বামীকে।’
চাঁদাবাজদের কাউকে চেনেন কি না এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী কখনও তাদের নাম-পরিচয় পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রকাশ করেননি। পরিচয় জানা থাকলে তাদের নাম উল্লেখ করেই মামলা করতাম।’
২০১৩ সালে মেম্বার দেবশ শীল হত্যার ঘটনায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয় পাংশা থানায় এই মামলায় এজাহারভুক্ত শিখা সাহা ও সন্দেহভাজন রতন মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তারা জামিনে মুক্ত হন।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় পাংশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মামলার আপডেট তথ্য তার জানা নেই।
ফয়েজুর হত্যা নিয়ে যা বলছে পুলিশ
রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল মর্গে ফয়েজুরের ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। কালুখালী থানার ওসি নাজমুল হাসান জানান, কারা কেন তাকে হত্যা করেছে, সে ব্যাপারে এখনও কিছু জানা যায়নি। তবে পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। হত্যা কী ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল তা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই হাসান শেখ বলেন, ‘আমরা তদন্ত করছি, তদন্তসাপেক্ষ এখনই কিছু বলা যাবে না। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনও পাইনি। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।’